আজকের এই তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। যে কোন রাষ্ট্র নায়কের জন্যে তিনটি রেখা পাশাপাশি থাকে। এক, সাফল্য, দুই ব্যর্থতা, তিন আততায়ীর হাতে নিহত হওয়া। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যে শেষের রেখাটিই বাস্তবে রূপ নিয়েছিলো। কেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছিলো, তা নিয়ে বহু মত আছে। সে সব ভবিষ্যতের গবেষকের বিষয়। কারণ, প্রকৃত ইতিহাসকে বিচার করতে অপেক্ষা করতে হয় শত শত বছর। যেমন সকালের ঘোলা পানিকে স্বচ্ছ করতে একটি পুকুরকে অপেক্ষা করতে হয় সন্ধ্যা অবধি।
তাই তাঁকে কেন হত্যা করা হয়েছিলো সে বিষয়ে না গিয়ে শুধু একটু চোখ রাখা যেতে পারে- এ মানুষটি এই ভূখন্ডের, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের জন্যে কী করেছিলেন?
এই ভূখণ্ড পাকিস্তান হয়েছিলো বাঙালি মুসলমানের জন্যে। তবে পাকিস্তান হবার কিছু দিন পরেই বোঝা যায়, সাবেক পূর্ববাংলা নামক এই ভূখন্ডের দরিদ্র মুসলমানের জন্যে পাকিস্তান নয়। পাকি্স্তান মূলত নবাব নাইটদের জন্যে। যে কারণে মজলুম জননেতা মওলনা ভাসানী মুসলিম লীগের বিপরীতে আওয়ামী মুসলিমলীগ অর্থাৎ জনগনের মুসলিমলীগ সৃষ্টি করেন। আর সেই জনগন বলতে ছিলো নিতান্ত দরিদ্র মুসলিম জনগন। এক পর্যায়ে মওলানা ভাসানীর সেক্রেটারী হিসেবে দীর্ঘ দিন ওই দলের কাজ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।
তারপরে আরও দীর্ঘ ইতিহাস। মোট ইতিহাসের সময়কাল বাইশ বছর হলেও ঘটনা তাকে অনেক দীর্ঘ করে। আর বাইশ বছরের সংগ্রামের ইতিহাসের ভেতর দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন এই ভূখন্ডের মানুষের মুক্তির একটি প্রতীক। নির্বাচিত নেতা হন তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে। তার দল সংখ্যাগরিষ্টতা পেলেও সেদিন ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় সে সময়ের পাকিস্তানি সামিরক জান্তা। সে সব ইতিহাস সকলের জানা।
আজ শুধু তার মৃত্যু দিনে এই হিসেবটি মেলানো যেতে পারে, বাইশ বছর তিনি ধাপে ধাপে যে সংগ্রামের পথে ছিলেন, সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সে সময়ের রাজনৈতিক নেতা ও তরুণরা মিলে যে স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করেছিলো সেই দেশ বাস্তবে কী দিয়েছে?
মূলত পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এই ভূখন্ডের বাঙালি মুসলিম যে আর্থিক স্বচ্ছলতা চেয়েছিলো সেটা তারা পাকিস্তানের ২২ বছরে পরিপূর্ণভাবে পায়নি- পেয়েছে বাংলাদেশ হবার ফলে। সর্বোপরি একটি দরিদ্র জনগোষ্টির অনেক বড় অংশ আজ মধ্যবিত্ততে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীব্যাপি পাচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে একটি আলাদা পরিচয়। এ দেশের পতাকা নিয়ে বিশ্ব পর্দার অংশ হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। যা মাত্র ১০ টি এ পৃথিবীতে। বাংলাদেশের নাগরিক জয় করছে পৃথিবীর সেরা পুরস্কার।
তাই ইতিহাসের যে কোন বাঁকে যাই ঘটুক না কেন, বাংলাদেশের পলিমাটি শেখ মুজিবুর রহমানের কপালে একটি বিজয় রেখা সব সময়ই এঁকে দেবে। কারণ সকল ধরনের স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে পূরণ করার জন্যে যে স্বাধীন দেশটির প্রয়োজন হয় সেই দেশটির সৃষ্টিতে সারাটি জীবনই তিনি ব্যয় করে গেছেন। আর তার দেহের সবটুকু রক্তস্রোত এ দেশের পলিমাটির সঙ্গেই মিশে আছে।
তাই এই মাটি থেকে উত্থিত তিনি এক ইতিহাস পরিবর্তনকারী। যে কোন জাতিকে এগিয়ে যেতে হলে তার বুকে তার মাটির যে প্রেরণা ধারণ করতে হয়, শেখ মুজিবুর রহমান এই মাটির সেই প্রেরণা। তিনি সকল দল ও মতের উর্ধে একটি দরিদ্র জনগোষ্টির মুক্তির নায়ক।
Leave a Reply