মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:২৭ পূর্বাহ্ন

রেবতিরা কি সব সময়ই পিসিমার পিছন পিছন চলে যাবে

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৪, ১০.৩০ এএম

স্বদেশ রায়

প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথের তিনসঙ্গী পড়ি তখন একেবারেই বালক। কেন যে ওই বয়সে ওটা পড়েছিলাম তা আজো মনে করতে পারিনা। তবে বইটির শেষের দুই লাইন কেন যেন মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো ওই বয়সে। কোন কিছুই বুঝিনি, শুধু অবাক হয়েছিলেম বলেই হয়তো অমন মুখস্ত হয়েছিলো,  “ হঠাৎআরেকটা ছায়া পড়লো দেয়ালে। পিসিমা এসে দাঁড়ালেন। বললেন. “ রেবি চলে আয়” । সুড় সুড় করে রেবতি পিসিমার পিছন পিছন চলে গেলো, একবারও ফিরে তাকালো না।“ এটাই শুধু অবাক করেছিলো। এছাড়া গোটা বইটার কিছুই বুঝিনি।

তারপর উচ্চ স্কুলে উঠে আবার যখন একের পর এক রবীন্দ্রনাথ পড়তে থাকি। তখনও সঠিক কিছু বুঝিনি। তারপরে আরো সময় গেছে, বাবার মরক্কো চামাড়ায় বাধানো রবীন্দ্র রচনাবলী মুক্তিযুদ্ধের সময় লুটেরাদের আগুনে পুড়ে গেছে। আমার রেক্সিনে বাধাই এক সেট রবীন্দ্র রচনাবলী যার পাতায় পাতায় ছিলো পেন্সিলের দাগ আর নিজের অজ্ঞতাপ্রসূত মন্তব্য সেটাও- এক পর্যায়ে দেখি ভাড়া বাড়ির ড্যাম দেয়ালের ফাঁক গলিয়ে উঁই পোকায় ধরেছে। বাদ দিতে হলো সেটা। তার জায়গায় আবার রেক্সিনে বাধানো বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র রচনাবলী জোগাড় করলাম। সেটাও হয়ে উঠলো গভীর রাতে অনান্য সকল বই এর শেষে কয়েক পাতা রবীন্দ্রনাথ যেন শান্তির বারিধারা। না এক অন্য চিন্তা।

আর রবীন্দ্রনাথ যখন এভাবে শান্তির বারিধারা হিসেবে এসেছে, অন্য চিন্তা হিসেবে এসেছে- ততদিনে একান্নবর্তী পরিবারটি এক দীর্ঘ অতীতের স্মৃতি। বরং তখন মনে পড়ে বালক বেলায় যখন বাবার সংগ্রহের সেই রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে তিনসঙ্গী পড়েছিলাম ওই সময়ে বাড়িতে অনেকদিন থাকা বা মাঝে মাঝে আসা পিসিমাদের কথা। আর একটু একটু করে মনে পড়তে থাকে, ওই সময়ে আমি কেন, বাড়ির সব থেকে যে রাশভারী মানুষটি, আমার মা, তিনিও তটস্থ থাকতেন পিসিমা কখন কি ফরমান জারি করেন তার ওপরে।

আজ বুঝতে পারি, পিসিমার কোন ফরমানই তার নিজের তৈরি ছিলো না।  সবই হাজার বছরের একটি সমাজের নানান জায়গা থেকে তার ভেতর জড়ো হয়েছিলো।

পিসিমারা কেন বদলাননি? কেন হাজার বছরের সেই স্থায়ী আসনটির ওপর তারা বসেছিলেন, এ একটি অনেক বড় প্রশ্ন! কেউ হয়তো বলবেন, মেয়েদেরকে সহজে বদলানো যায় না। কিন্তু তার উত্তর রেবতি তো নিজেকে বদলাতে চেয়ছিলো। তাছাড়া ছেলেদের বদলানো যায়, মেয়েদের বদলানো যায়না এ বড় অসত্য এক কথা।

কিন্তু কেন রবীন্দ্রনাথ যে সমাজ দেখেছিলেন  সে সমাজে তার এই লেখার প্রায় শত বছর পরেও এসেও তৃতীয় বিশ্বে এই বদলের কোন ছাপ নেই। এমনকি উন্নত বিশ্বে কিছু ঝলক এলেও তাও বদলে দেবার এক চেষ্টা হিসেবে দেখা দেয়,  আবার চলে আসে পুরানো সেই দেয়ালের ছায়ায়।

পিসিমারা কেন পিসিমাদের জায়গাতেই থাকেন এ নিয়ে যদি খুব সাধারণ একটা উদাহরণে যাওয়া যায় তাহলেও এক অদ্ভূত ঘটনা সামনে আসে।

যেমন যৌথ পরিবারে থেকে দেখেছি, বাড়ির যে কুলোপুরোহিত বা দাদাঠাকুর, তিনিও পিসিমাকে বলছেন, একাদশীর জন্যে তোমার নিরম্বু উপবাসের দরকার নেই। ডাব খেতে পারো। দুধ খেতে পারো। পিসিমা তার কথাও শুনছেন না।

পিসিমা যেন এখানে নিজেই রেবতি। পার্থক্য শুধু এটুকু, রেবতি রাষ্ট্র ও সমাজে বিপ্লব করতে গিয়ে নিজেই লগ্ন ছাড়া বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কিন্তু পিসিমা ডাক দিলেই সে সবাই কে ফেলে সুড় সুড় করে পিসিমার পেছনে পেছনে চলে যায়। আর এখানে কুলোপুরোহিত বলার পরেও পিসিমা নিজেই নিজের সেই সনাতন পথে সুড় সুড় করে চলছেন।

রবীন্দ্রনাথের যত লেখায় এই রাষ্ট্র বিপ্লব আর সমাজ বিপ্লব নিয়ে কথা এসেছে- সবখানে দেখা গেছে, পরিবর্তন চাওয়াদের-  তেজ আছে, বিদ্রোহ আছে, তবে সবই আকাশের বজ্রপাতের মতো, একবার শব্দ তোলে, একবার জ্বলে ওঠে তারপরে আবার স্বাভাবিক আকাশের সঙ্গে মিশে যায়।

সেদিন আমেরিকা প্রবাসী প্রখ্যাত গুনি সাংবাদিক সৈয়দ শহীদ ভাই এর সঙ্গে আশা ও হতাশার কথা বলতে গিয়ে চলে এসেছিলো রবীন্দ্রনাথের কথা। উনি বললেন, রবীন্দ্রনাথকে তো এসব লিখতে হয়েছিলো তার দেশ ও মানুষের প্রয়োজনে। তিনি আরো অনেক বড় কিছু করতে পারতেন। তারপরে দেশও মানুষের প্রয়োজনে এগুলো লিখেছিলেন।

 জানিনা রবীন্দ্রনাথ কেন লিখেছিলেন। তবে আমাদের জীবদশ্মায়, আমাদের যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গেছে। আমাদের সমাজ ভেঙ্গে গেছে। আমাদের রাষ্ট্র বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। তারপরেও দেয়ালে কেবলই দীর্ঘ হয়েছে পিসিমার ছায়া। আর রেবতিরা বার বার সুড় সুড় করে চলে গেছে পিসিমার পিছে পিছে।

আবার কখনও কখনও মনে হয়, রেবতীরা যখন যাই হোক না কেন, ওদের ভেতরটা জুড়েই কি প্রতি প্রজম্মে বেড়ে উঠছেন পিসিমারা। তাই দীর্ঘ হচ্ছে পিসিমাদের ছায়া। আর দিন দিন সংখ্যা বাড়ছে অমনি সুড় সুড় করে চলে যাওয়া রেবতিদের।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World. 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024