পিওতর মান্তেইফেল
পেটুক পাইথন
ভারত থেকে মস্কোয় আনা হল জালি-আঁকা এক পাইথন। পৃথিবীর বৃহত্তম সাপেদের অন্যতম এরা। এই দানবটি ছিল লম্বায় প্রায় আট মিটার, ওজনে একশ বিশ কিলোগ্রাম।
এহেন অজগরের শক্তি বিপুল। প্রকাণ্ড দেহের পাকে পাকে সে জন্তুকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিয়ে তার বুক পিষতে থাকে, যেন ইস্পাতের সাঁড়াশি। কবলে পড়া জন্তুটির দম বন্ধ হয়ে যায়, করাল আলিঙ্গনে মারা পড়ে সে। আর শিকারের দেহের খিচুনি যখন থেমে যায়, তখন তার পাক খুলতে থাকে সাপ, এবং নিশ্চল জন্তুটার মাথা থেকে শুরু করে গোটাগুটি গিলতে থাকে তাকে, খিদে মেটায় মাসখানেক কি আরো বেশি দিনের জন্যে।
নিজের বধ্যের হাড় কখনো ভাঙে না পাইথন, যদিও তার পক্ষে সেটা খুবই সহজ। সাপের এই বৈশিষ্ট্যটা গড়ে উঠেছে বহু যুগ ধরে খাদ্য গ্রহণের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবার উপায় হিশেবে: কবলে পড়া জন্তুটির হাড় ভেঙে গেলে তা চামড়া ফুটে বেরিয়ে পড়তে পারে, তাতে গেলার পক্ষে সাপের অসুবিধা হয়।
এই সাপটার সবচেয়ে মোটা অংশটার ব্যাস ছিল ত্রিশ সেন্টিমিটার। কিন্তু যখন সে তার ‘ডিনার’ গিলত, তখন দিন দুয়েক পর তা দেখতে দেখতে ফুলে উঠত অবিশ্বাস্য রকমে।
চিড়িয়াখানায় পাইথনটাকে খাওয়ানো হত শুয়োর-ছানা, কখনো কখনো প্রায় একমনী এক-একটা ধেড়ে শুয়োর, কিন্তু সাপের হাঁ কীভাবে প্রসারিত হয়ে উঠছে তা দেখলে মনে হবে আরো অনেক বড়ো জন্তুও সে গিলতে পারে।
একবার মস্কো চিড়িয়াখানার একটা পাইথন গিয়ে সে’ধয় পাশের বয়স্ক কুমিরদের ডেরায়। তাদের একটাকে সে দমবন্ধ করে মেরে গোটাগুটি গিলে ফেলে। এ রকম মাত্রাতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণে শঙ্কিত হয়ে ওঠে অনেকে, এমনকি অপারেশন করে কুমিরটা বার করার পরামর্শ দেয় ডাক্তাররা। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই পাইথন তাকে হজম করে ফেলে, হজম হয় নি কেবল শৃঙ্গজাতীয় বস্তু কুমিরের আঁশ (খোলা) আর নখ, যা পরে পাওয়া যায় তার বাহ্যে।
যে পাইথনটাকে শুয়োর খাওয়ানো হত, সে অনায়াসে তাকে পরিপাক রসে জীর্ণ করে ফেলত: হজম হত না কেবল লোম, খুর আর দাঁতের এনামেল।
পরিপাকের দ্রুততা পুরোপুরি নির্ভর করত ঘরের তাপমাত্রার ওপর। সেটা বোঝা যায়, কেননা কুমির, গিরগিটি, কাছিমের মতো সাপের দেহেও স্থায়ী তাপমাত্রা থাকে না।
পাইথন বিষাক্ত নয়। কেউটে, তক্ষক প্রভৃতি বিষধর সাপ তাদের শিকার মারে বিষ দিয়ে, ওপরের চোয়ালের বড়ো বড়ো দুটো বিষ-ভরা সচল দাঁতের ছিদ্র (কেউটে) বা খাত (তক্ষক, গিউরজা, ড়্যাট্ট্ল স্নেক) দিয়ে সে বিষ তারা নিষেক করে রক্তে। কামড় খাওয়া জন্তু কখনো কখনো পালিয়ে গিয়ে মারা পড়ে দূরে, তাহলেও সাপ তাকে খুঁজে বার করে।
সাপ প্রাণীর অনুসরণ করে চিহ্ন ধরে, তার দু’ভাগে চেরা লম্বা জিব দিয়ে মাটি আর আশেপাশের উদ্ভিদ পরখ করে করে। অনেকে ভুল করে সাপের জিবটাকে মনে করেন ‘হুল’। এ অঙ্গটির বেদিতা অসাধারণ বিকশিত; জিব তার ঘ্রাণশক্তির অভাব মেটায়।
চিড়িয়াখানায় গ্রীষ্মকালে আমরা ইউরোপের চলতি ঘাস-সাপগুলোকে রাখি খোলা জায়গায়। নাছোড়বান্দার মতো ব্যাঙের পেছনে তাড়া করে তারা। ঘাসের ভেতর তাদের চিহ্নের পিছু পিছু এগিয়ে শিকার ধরে কেবল তখন, যখন ব্যাঙ এত ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে লাফাতে পারে না, কেবল ছে’চড়ে ছে’চড়ে যায়।
সাহিত্যে মাঝে মাঝে এমন কথা লেখা হয় যে সাপ নাকি তার চোখ দিয়ে ‘সম্মোহিত’ করে তার শিকার। এটা কিন্তু একেবারেই ভুল। বোরো কি পাইথন সাধারণত খুরওয়ালা, তীক্ষদন্ত বা অন্যান্য প্রাণীকে আকৃষ্ট করে তাদের একান্ত নিশ্চলতা আর আঁশ-আঁশ চামড়ার ছটা দিয়ে। শিকার চোখে পড়লে পাইথন পাক দিয়ে দিয়ে গুটিয়ে গিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, কখন তা কাছে আসবে।
প্রাণীটা ওদিকে পাইথনের চেহারায় আকৃষ্ট হয়ে অদৃষ্টপূর্ব জিনিসটাকে দেখতে থাকে এবং এত কাছিয়ে যায় যে পাইথন অব্যর্থ লক্ষ্যে দাঁত বসিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তার পেশল পাকে তাকে জড়িয়ে ফেলে।
সাপের হাত থেকে শিকার ফসকায় কদাচিৎ, কিন্তু পেট ভরা থাকলে সে তাদের ছোঁয় না, তাই ভয়ঙ্কর শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের পূর্ব-অভিজ্ঞতা এসব প্রাণীর থাকে না।
অজগরের নির্মম আলিঙ্গন থেকে পালাতে বেশি পারে বানর। সাপ দেখলেই ওরা যে ভারি সচকিত হয়ে ওঠে তাতে অবাক হবার কিছু নেই, কেননা সাপের কাছে উঁচু গাছ কোনো বাধাই নয়, আর বেশির ভাগ সাপ গাছে চাপে রাত্রে, যখন বানররা ঘুময়। যেকোনো শক্তিশালী হিংস্র জন্তুর দিকে শিম্পাঞ্জি তাকায় কোনো পরোয়া না করে, কিন্তু সাপ দেখলে আতঙ্কে তারা পালায়।
এই হল প্রাকৃতিক নির্বাচন ও নিজস্ব অভিজ্ঞতার ফল আর সাপই হল বানরের সবচেয়ে গুরুতর শত্রু। স্বভূমিতে, আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনে, অতি বিষধর সমেত নানাজাতীয় সাপ যেখানে প্রচুর, সেখানে পাখির বাসা আর ডিমের খোঁজে শিম্পাঞ্জিরা গাছের কোটরের দিকে এগোয় অতি সাবধানে: কেননা প্রতি কোটরেই বিষধর সাপ থাকতে পারে পাখির বদলে।
বছরকয়েক আগে বাইরে থেকে মস্কোর চিড়িয়াখানা পায় দু’টি শিম্পাঞ্জি: মর্দাটার নাম গান্স, মাদীটার লিজা।
থাকত তারা একসঙ্গে, একই খাঁচায়। গান্সের ছিল একটা পালোয়ানী শরীর আর জঙ্গী মেজাজ। তার আর লিজার কাছে যেতে সাহস হত না কারো, অমন যন্ডার সঙ্গে তামাসার ফল খুবই খারাপ হতে পারত। এদের অন্য একটা জায়গায় সরাবার প্রয়োজন যখন হল, তখন প্রমাদ গণলাম আমরা। সত্যি, হিংস্র জন্তুটার কাছে যাওয়া যায় কীভাবে, কী করে ওাক বইবার খাঁচাটায় ঢুকিয়ে নতুন ‘ফ্ল্যাটে’ নিয়ে যাওয়া
যায়? দরজার মুখে মুখে লাগিয়ে আমরা ওদের পরিবহণ-খাঁচাটায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঢোকাবার চেষ্টা করলাম। লিজা ঢুকল আগ্রহ করেই, কিন্তু গোঁ ধরে রইল গাল। তারপর ফাঁসে উঠল সে, ভয়ঙ্কর গর্জন করে ছোটাছুটি করতে লাগল চারিদিকে।
আমাদের কোনো তাড়নাতেই কান দিলে না ক্ষ্যাপা জন্তুটা। তখন আমরা দমকল থেকে ঠান্ডা জলের তোড় ছাড়লাম, কিন্তু কোনো ফল হল না। শুধু তাই নয়, এইসব হৈচৈ আর হাঁক-ডাকে লিজাও ছটফটিয়ে উঠে ফিরে এল আগের খাঁচাটায়, দাঁড়াল গান্সের পাশে।
কিছুতেই পরিবহণ-খাঁচাটায় যেতে চাইছিল না ওরা, ক্রমেই বেশি করে ক্ষেপে উঠতে লাগল গাস।
তখন চিড়িয়াখানার বানর-বিভাগের অধ্যক্ষ শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলেন।
কিশোর জীববিদকে বললেন, ‘একটা ঘাস-সাপ নিয়ে এসো তো।’
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্যানভাসের থলিতে করে আনা হল সাপটাকে।
খলি থেকে সার্পটার কালো দেহ দেখা যেতে না যেতেই প্রচণ্ড আতঙ্ক পেয়ে বসল অবশীভূত গান্সকে।
বিস্ফারিত চোখে সে প্রথমে আত্মরক্ষার ভঙ্গি নেয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই পেছতে শুরু করে, পা গুটিয়ে অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে।
ছেড়ে দেওয়া হল সাপটাকে, ক্রমেই কাছিয়ে এল তা। লিজা অনেক আগেই পরিবহণ-খাঁচাটার দূর কোণে গিয়ে লুকিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত গান্সও একেবারে পড়ি-মরি ছুটল সেখানে। বন্ধ হয়ে গেল দরজা। অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল তাদের।
নিরীহ ঘাস-সাপ দেখে এতই উদ্ভ্রান্ত হয়েছিল গান্স যে সারা দিনটা সে পাগলা-পাগলা হয়ে থাকে।
বেচারি গান্স! কী করে ওকে বোঝাই যে ঘাস-সাপ মোটেই বিষধর কেউটে নয়, তাকে ভয় পেতে পারে কেবল ছোটো ছোটো মাছ আর ব্যাঙ?
Leave a Reply