সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২০ অপরাহ্ন

‘এই স্থানে স্থানে উন্মত্ত জনতাকে কীভাবে ঠেকাবো?’

  • Update Time : শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৪, ৪.৩২ পিএম
আদালত থেকে বের করার সময়া হাসানুল হক ইনুকে আঘাত করছেন একজন

আবুল কালাম আজাদ

বাংলাদেশে আদালত প্রাঙ্গনে আসামিদের ওপর হামলা এবং জুলাই-অগাস্টের ছাত্র আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাগুলো নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আদালতে হামলা এবং মামলার বিষয়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে নির্দেশনা দেয়ার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি।

মঙ্গলবার ঢাকার সিএমএম (চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট) আদালতে সাবেক মন্ত্রী এবং চৌদ্দ দলের নেতা হাসানুল হক ইনু এবং রাশেদ খান মেননকে হাজির করা হলে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে।

জাসদ সভাপতি ইনুর প্রতি উপস্থিত আইনজীবী এবং জনসাধারণের ক্ষোভ দেখা যায়। হত্যা মামলার আসামি হিসেবে তাদেরকে আদালতে তোলার সময় ডিম নিক্ষেপ, কিল ঘুসি ও লাথি মারতে দেখা যায়।

 প্রথম মামলায় রিমান্ড মঞ্জুর করে দুজনকে এজলাস থেকে কঠোর পুলিশি পাহারায় বের করে নেয়ার মুহূর্তেও ইনুকে জুতা পেটা করতে দেখা যায়।

সিলেট আদালতে হাজির করার সময় আক্রমণের শিকার সাবেক বিচারপতি মানিক

গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে আদালতে আনা নেয়ার পরেও হামলা এবং হেনস্থা বন্ধ না হওয়ার বিষয়টিকে উদ্বেগের বলেই মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।

এর আগে সীমান্তে আটক হওয়ার পর সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে সিলেটের আদালতে হাজির করার সময় তিনি ব্যাপক আক্রমণের শিকার হন। হামলায় গুরুতর জখম হন তিনি।

আদালত কারাগারে পাঠালে তাকে সেখান থেকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। শরীরে অস্ত্রোপচার শেষে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখতে হয়।

এছাড়া ঢাকার সিএমএম আদালতে বাংলাদেশ ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় এবং সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি আদালেত বাজে রকম হেনস্তার শিকার হন।

আদালতের গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের সঙ্গে যা ঘটছে সেটি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে বন্ধ করা দরকার বলেই মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, “এটা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন না এটির বর্ণনা কীভাবে দিব জানি না। আদালত কিন্তু একটা মানুষের মুক্ত বিচরণক্ষেত্র হওয়ার কথা। যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে আদালতে উপস্থাপন করছে তখন যে ঘটনাগুলো আমরা দেখছি কিল, ঘুসি, জুতা মারা তারপর শারীরিকভাবে নির্যাতন করা যেমন জাস্টিস মানিকের যে ঘটনাটা দেখলাম, দীপু মনি তারপর জয়ের যে ঘটনাটা দেখলাম এই ঘটনাগুলো কিন্তু কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না।”

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন

তিনি বলেন, এই ঘটনাগুলো যাতে আর না ঘটে সেজন্য আরো সতর্ক হতে হবে।

“মনে রাখতে হবে দীর্ঘদিন কিন্তু আমরা নিষ্পেষিত ছিলাম, নির্যাতনের মুখোমুখি ছিলাম। আমরা কথা বলতে পারিনি। সেটা যখন একটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতো অবস্থা আজকে ছাত্র-জনতার রক্তের মধ্যে দিয়ে আমরা পেয়েছি, সেই জায়গাটিকে কোনোভাবেই ধ্বংস হতে দেয়া উচিত না। কালিমালেপন করতে দেয়া উচিৎ না,” যোগ করেন মি. খান।

“যে ঘটনাগুলো আদালত পাড়ায় ঘটছে এবং বিশেষ করে আইনজীবীরাও যখন যুক্ত হয় এবং আসামির পক্ষে আইনজীবীদের দাঁড়াতে কোনো কোনো আইনজীবী বাধা দিচ্ছেন এই কাজগুলো কিন্তু আজকে যে বিজয় সেই বিজয়কে ম্লান করে দিবে। এটা কোনোভাবে বিদেশে বা দেশে শুভ বার্তা দিচ্ছে না। দেশের সাধারণ মানুষও যেমন এইটা পছন্দ করছে না, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কিন্তু এটি নিয়ে আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করবে।”

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর আদালতে আসামি উপস্থাপনের আগে সেনাবাহিনী এবং পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই হামলা আক্রমণ চলছে। পুলিশকে আক্রমণকারী বা হামলার সঙ্গে জড়িত কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল

এ ব্যাপারে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকার এগুলো সমর্থন করে না। ভবিষ্যতে এসব বন্ধ করতে কিছু কৌশল নেয়ার কথাও জানান উপদেষ্টা ।

“আমরা কোনোভাবেই এটা সাপোর্ট করি না। এই বাস্তবতাটাও আপনারা একটু বিবেচনায় নিবেন অনেক মানুষেরতো ক্ষোভ আছে ক্রোধ আছে, রাগ আছে। এখন সবকিছু যদি আমি ওভারনাইট আশা করি যে প্রত্যেকটা মানুষ মহাত্মা গান্ধীর মতো আচরণ করবে এটাও একটু বাড়াবাড়ি, আবার এটা একসেপ্ট করাটাও অসম্ভব ব্যাপার। আমরা এটা কোনোভাবেই চাই না তারপরেও এটা অন্য কীভাবে রিজলভ করা যায় আমরা কিছু কৌশল চিন্তা করেছি। এটার বাস্তবায়ন আপনারা দেখবেন।”

মামলা নিয়ে প্রশ্ন

বাংলাদেশের অলরাউন্ডার ক্রিকেটার এবং সাবেক এমপি সাকিব আল হাসানের একটি মামলা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং জনপরিসরে ব্যাপক আলোচনা তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। সাকিব আসামি হয়েছেন গার্মেন্টস কর্মী মোহাম্মদ রুবেল হত্যা মামলায়। ঘটনার সময় বিদেশ থাকার পরেও এ মামলায় সাকিবের নাম জড়ানোয় হত্যা মামলার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আদাবর থানায় ওই মামলায় ২৮ নম্বর আসামি সাকিব। ওই মামলায় ১৫৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৪/৫শ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদী রফিকুল ইসলাম নীলফামারিতে থাকেন।

মামলার এজাহারে বাদির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যে মোবাইল নম্বরটি দেয়া হয়েছে সেটি ভিন্ন একজন ব্যক্তির। নম্বরটি যার কাছে আছে তিনি মামলা করতে বাদীকে সহায়তা করেছেন। নম্বরধারী ওই ব্যক্তি একজন আন্দোলনকারী এবং ভিকটিমের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। বাদী পক্ষ মামলা নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয় বলে তিনি বিবিসিকে জানান।

সাকিব আল হাসান

বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহতদের বিচারের দাবিতে ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে। এবং আরো মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। এরমধ্যে রংপুরে নিহত মানিক মিয়া হত্যা মামলা রুজুর করতে আদালতে একটি আবেদন করা হয়েছে যেখানে বাদী নিজেই দাবি করেছেন আসামিদের নাম তিনি দেননি।

রংপুর আদালতে মানিক মিয়া হত্যা মামলার আবেদনে বাদী হিসেবে ১১৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত বিপুল সংখ্যক আসামি করা হয়। মামলাটির পরবর্তী শুনানি দুই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। মামলার বাদী হিসেবে নাম দেয়া হয়েছে নুরজাহান বেগমের। এই মামলার আবেদন প্রসঙ্গে মানিক মিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয় শতাধিক আসামির নাম প্রত্যাহার করতে চান তারা। বিষয়টি নিয়ে তারা রংপুরের ছাত্র সমন্বয়কদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

মানিক মিয়ার মা নুরজাহান বেগম বিবিসিকে বলেন, তার কাছ থেকে মামলার আবেদনটিতে সই নেয়া হয়েছে।

“একটা আসামির নামও আমি বলি নাই। একটা লোকেরও আমি নাম দেই নেই। এগুলা উকিলেরা কী কী করছে বাবা আমি বলতে পারি না। আমি সই দিতে চাই নাই তাও আমার থেকে সই নেছে। আমার জামাইর নাম দেছে, আমার ভাইয়ের নাম দেছে, আমার বওনাই’র নাম দেছে।”

আদালতে মামলার ফাইল করেছিলেন আইনজীবী আলাউদ্দিন। তিনি জানান, বাদী মামলার উকিল চেঞ্জ করছে।

অভিযুক্ত আসামিদের নাম কীভাবে দেয়া হলো এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “মামলার বাদী আছে, সাক্ষী আছে ওনারাই দিয়েছিল। আমার এখানে কোনো ইয়া আছে?”

ছাত্র আন্দোলনে হত্যার বিচারের দাবিতে মামলাগুলোর এজাহার দেখে একই প্যাটার্নের ধরনের মনে হচ্ছে। পদচ্যুত সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি পুলিশ, দলীয় সংগঠনের নেতাকর্মীদের গণহারে আসামি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিক, খেলোয়াড়, অভিনেতা ও বিচারকদের আসামি করা হচ্ছে।

যাত্রাবাড়ী থানার অধীনে শিক্ষার্থী নাইম হাওলাদার হত্যা মামলায় ১৯৩ জনকে আসামি করা হয়েছে যার মধ্যে সাতজন সাংবাদিকের নাম রয়েছে। বাদী কামরুল ইসলাম টেলিফোনে দাবি করেন তিনি নিজেই এই সাংবাদিকদের নাম উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, “সাংবাদিক যে আছে, তাদেরতো দোষ-ত্রুটি আছে নাকি। আছে না? সাংবাদিকতো সব একই দলের না। বিভিন্ন দলেরই আছে। কিছু উসকানিমূলক কথাবার্তা লেখে, উসকানিমূলক কথাবার্তা বলে।”

ছাত্র আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় নির্বিচারে মামলাগুলো নিয়ে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, এই মামলাগুলো আসলে ধোপে টিকবে না।

“আমি জানি না সাকিব আল হাসানকে কীভাবে যুক্ত করা হয়েছে। আর সাংবাদিকদের ব্যাপারে কিন্তু খুব স্পষ্টভাবেই বলা যায় যে এটি কীভাবে সম্ভব! একটা ঘটনায় সাতজন সাংবাদিককে মামলার আসামি করে দেয়া। যেভাবে আসামি দেয়া হচ্ছে এবং যেভাবে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের কথা বলা হচ্ছে এটি ঠিক পুরানো যে মামলার সংস্কৃতি দেখেছে গত সরকারের আমলে তারই পুনরাবৃত্তি আমার কাছে মনে হচ্ছে।”

প্রায় প্রতিটি মামলার এজাহারে দেখা যায় একটি ঘটনায় বহু আসামি

মামলা প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা বলেন কিছু মামলা তাদের জন্যেও বিব্রতকর।

“সাকিবের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের কমপ্লেইন থাকতে পারে, মানুষের অনেক দুঃখ থাকতে পারে তার বিভিন্ন আচরণ নিয়ে কিন্তু হত্যা মামলা একটু একসেপ্ট করা খুবই কঠিন। এখন কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে মামলা করে বাংলাদেশের আইনে এইটা আপনি লিগ্যালি বাধা দিতে পারবেন না।”

মামলাগুলো যাচাই বাছাই করে আসামি বাদ দেয়ার সুযোগ থাকলেও সেটি এখন চাপের কারণে সম্ভব হচ্ছে না বলে স্বীকার করেন আইন উপদেষ্টা।

“এত চাপ সৃষ্টি করে স্থানীয় মব। পুলিশের কাছে এসে বলে এইভাবেই মামলা দিতে হবে। এইটাই দিতে হবে। দে ফিল ইনসিকিওর। এবং রাজি না হলে বলে তোমরাতো ফ্যাসিস্ট গর্ভমেন্টের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলা, ফ্যাসিস্ট গর্ভমেন্টের পুলিশ ছিলা। আমরা এই স্থানে স্থানে উন্মত্ত জনতাকে কীভাবে ঠেকাবো?”

সমাধানের চেষ্টা প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, “আমরা তবু পলিটিক্যাল পার্টিগুলার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি যে তাদের মাধ্যমে একটু নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না। আপনারা মনে কইরেন না এই সিচ্যুয়েশনগুলো আমরা লাইক করছি। আমরা পছন্দ করছি না। আমরা যতটা পারা যায়, যতভাবে পারা যায় এই দুইটা প্রবলেম রিজলভ করার চেষ্টা করবো।”

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024