মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
মাহমুদুল হক
খোকা ভাই আমার, আমার এ গাল বড় আদরের, বড় যত্নের, জীবনভর মনে রেখো, থাপ্পড় পড়েছে আমার এই গালে, আগুনের শিখার মতো পাঁচটা আঙুলের দাগ বসেছে এই গালে। বলো লজ্জা লজ্জা লজ্জা! বলো ঘৃণা ঘৃণা ঘৃণা! বলো কি অশ্লীল এ দাগ!
আর লিখো না, দলামোচড়া ক’রে ছুঁড়ে দিও না খাটের তলায়। অনেক লিখেছো, অনেক ধ্বংস করেছো, ঢের হয়েছে, এখন তোমার খেলা বন্ধ করো, খোকা, ভাই আমার, চেয়ে দ্যাখো কি ক্লান্তি! কি বিতৃষ্ণা!
সন্ধ্যা পার হ’য়ে রাত্রি গড়িয়েছে সেই কখন। কিছুই জানে না থোকা। তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো সে পড়েছিলো; ডিমের খোলের ভিতর একটু একটু ক’রে সে প্রাণ সঞ্চয় করছিলো। সে জানে, আজ তার নবজন্য হয়েছে। আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে, তার আর কোনো সমস্যা নেই, সমস্যার পীড়ন নেই, সবকিছুর সমাধান ক’রে ফেলেছে সে।
ঘরে ফিরে জামার বোতাম খুলতে খুলতে রাজীব ভাই বললে, ‘শুনলে কিছু?’
‘কই না।’
‘শুনলাম সবকিছু মিটমাট হ’য়ে গেছে।’
‘কিছুই শুনিনি!’ খোকা অপরাধীর মতো স্বীকারোক্তি করলে।
‘ইয়াহিয়া-ভুট্টো নাকি ছ’দফা মেনে নিয়েছে। টেলিগ্রামও বেরিয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় ভিড়, এখন কেবল রেডিও টেলিভিশনে সরকারি ঘোষণার অপেক্ষা–‘
‘রক্তারক্তিটা তাহলে এড়ানো গেল শেষ অব্দি?
‘কি জানি, হয়তো শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে শয়তানগুলোর। এছাড়া আর কোনো পথ তো ছিলো না, দেখাই যাক!’
হাতমুখ ধুয়ে এসে রাজীব ভাই বললে, ‘কথা হয়েছে নীলার সঙ্গে? যা ব্যতিব্যস্ত ক’রে তুলেছিলো আমাকে। তোমার অসুবিধের কথা আমি বুঝি, বুঝলে কি হবে, এমন গোঁ ধ’রে বসেছে, বাধ্য হ’য়ে তোমাকে বলতে হ’লো। এখন বোঝানো যাবে। তুমি বোধহয় অব্যাহতি পেলে।’
খোকা উঠি উঠি করায় রাজীব ভাই বললে, ‘আরে বোসো বোসো, যাবেই তো, এসো একহাত হ’য়ে যাক আজ–‘
দাবার বোর্ড আর ঘুটি বের করলে রাজীব ভাই। খোকার কাছে এটা একটা চ্যালেঞ্জ মনে হ’লো। কিছুটা ধারালো রাজীব ভাইয়ের মুখ। হুট ক’রে দাবার বোর্ড টেনে বের করাকে খুব সহজে নিতে পারে না খোকা। কয়েক চালেই হাতি আর মন্ত্রীর যৌথ আক্রমণ রচনা করলো রাজীব ভাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুলকি চালে ঘোড়াও এসে জুটলো। ভীষণভাবে আক্রান্ত হ’য়ে গেল খোকা। রাজা সামলাতে গিয়ে এক এক ক’রে বহু ঘুঁটি হারাতে হ’লো তাকে; তারপর সামান্য একটু অসতর্কতার সুযোগে ঘোড়ার চালে কিস্তি দিয়ে তার শেষ শক্তি মন্ত্রীকেও ছোবল দিলো রাজীব ভাই। রিজাইন দিয়ে মুখ রক্ষা করলো খোকা। পরের বার খুব ধীরে-সুস্থে চাল দেওয়া শুরু করলো রাজীব ভাই।
Leave a Reply