মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
মাহমুদুল হক
ক্রমাগত ফুলছিলো রাজীব ভাইয়ের লাশ। এক বিকট গহ্বর ঠেলে বেরিয়ে আসছিলো ক্ষত-বিক্ষত জিভ। যাবতীয় ধ্বংসস্তূপের ভিতর এই মানুষটিই সবচেয়ে বেশি অনাত্মীয় হ’য়ে উঠেছিলো তিনটি প্রাণীর কাছে; কেননা রাজীব ভাইয়ের লাশের গন্ধে সকলেরই নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।
খোকার গল্পের এখানেই সমাপ্তি।
নুরুদ্দিন, মওলা, মুরাদ, বেলী, নীলাভাবী কিংবা রাজীব ভাইয়ের পরিচিত সেই খোকা সম্পর্কে এই ঘটনার পর বলবার মতো আর কী-ই বা এমন থাকতে পারে! দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এমন এক সর্বনাশা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভিতরে গিয়ে পড়েছিলো যে খোকা নিজের কাছে নিজেই বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট ছিলো না।
দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত জ্বলেছিলো সর্বগ্রাসী আগুন। উন্মত্ত সৈন্যরা দেশকে ধ্বংসস্তূপ কিংবা শ্মশান তৈরির পরিকল্পনায় নৃশংস বর্বরতার চরম পথই বেছে নিয়েছিলো। দেশের বিরাট একটি অংশ লাল মরণোল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মুক্তিযুদ্ধে।
মুরাদ, রহমান, এমন কি ইয়াসিনও মুক্তিযোদ্ধা হ’য়ে লড়াই করেছে! রহমান নিহত। ইয়াসিন পঙ্গু। গেরিলা কমান্ডার মুরাদের বীরত্বের খ্যাতি গোপনে গোপনে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো।
খোকার গল্পের এইখানেই সমাপ্তি, কেননা থোকা এমন কিছুই করেনি যে ইতিহাসের পাতায় তার নাম থাকবে। মুমূর্ষু বাঙালি জাতি ইতিহাস তৈরির নেশায় মেতে উঠেছিলো; এক পলায়ন ছাড়া সেখানে খোকার কোনো ভূমিকা নেই, ইতিহাসের ধূসর আড়ালে খোকারই তো প্রথম মুখ লুকোবার কথা।
দু’দিন পর কয়েক ঘন্টার জন্যে কারফিউ তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে রাজীব ভাইয়ের লাশ ফেলে বাড়িতে ছুটেছিলো সে, এবং রঞ্জুকে পেয়েছিলো।
কিন্তু তারপর? খোকার নিজেরই এখন আর সবকিছু হুবহু মনে নেই। কেবল অস্পষ্টভাবে কিছু কিছু ছবি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। প্রাণভয়ে ভীত হাজার হাজার নরনারীর সঙ্গে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠেছিলো সেঃ প্রতিটি গাছের ছায়া তখন এক একটি বিরাট অট্টালিকা সেখানে।
আমি ক্র্যাক ডাউনের প্রথম রাত্রেই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো রজু। গাছের নিচে শতরঞ্চি বিছিয়ে তাকে শুইয়ে রেখেছিলো খোকা। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে থৈথৈ মানুষ, যে যার নিজের পরিবারকে, নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। এই অবস্থায় হলো তুমুল ঝড়, সেই সঙ্গে শিলাবৃষ্টি।
বৃষ্টিতে ভিজে সেই রাত্রেই জ্বর এসেছিলো রজুর। মাথা ঠিক ছিলো না খোকার। বুদ্ধি লোপ পেয়েছিলো, কি করবে, কি করা উচিত, কিছুই সাব্যস্ত করতে পারেনি সে।
তারপর কি কোথায় সব ঘটেছিলো এখন আর তা মনে নেই খোকার। আমি কি সেখানে ছিলাম, খোকা জিগ্যেশ করে নিজেকে, আমি কি স্বচক্ষে কোনো কিছু দেখেছি, হাবুডুবু খেতে থাকে থোকা এইভাবে। ভোর না হতেই পলায়মান ভীতসন্ত্রস্ত নরনারীর ওপর অতর্কিতে পাশবিক উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মেশিনগান ও মর্টার সজ্জিত ক্ষিপ্র সৈন্যদল, এখনো মানুষজন এইসব বলাবলি করে। অচৈতন্যপ্রায় রজ্জুকে গাছতলায় শতরঞ্চির উপরে ফেলে প্রাণঘাতী গুলিবৃষ্টির ভিতর হাজার হাজার নরনারীর মতো আমিও কি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়েছিলাম, ভেবে পায় না খোকা; যেন একটা দুঃস্বপ্ন। মন থেকে সবকিছু মুছে ফেলতে চায় খোকা। একলক্ষ চল্লিশ হাজার পায়ের তলায় প’ড়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা হ’য়ে গিয়েছিলো কি নিরঞ্জন রঞ্জু?
কিছুই জানে না খোকা। সে শুধু চেয়েছিলো রঞ্জু বেঁচে থাকুক। সে জানতো না এটা তার ভুল। একা বেঁচে থাকার অধিকার তার বিষণ্ণ দেশ কিছুতেই দিতে পারে না রজ্জুকে, খোকা পরে বুঝেছিলো।
দেশ তাহলে একটা পুকুর। অঞ্জু মঞ্জুর মতো এর নিস্তরঙ্গ নিথর তলদেশে চিরকালের জন্যে হারিয়ে গিয়েছে রঞ্জু। এই নির্জন পুকুর পাড়ে একা একা সারাটা জীবন যে সে কি ক’রে কাটাবে খোকা তা ভেবে পায় না; সে তো জানেই সহজে তার মৃত্যু নেই, কেননা কোনো অসতর্ক মুহূর্তে যদি এমন কথা তার মনে উকি দেয়, তখনই রঞ্জু তাকে শাসন ক’রে বলে ‘দাদা, আমি না তোর বুকে থুতু দিয়েছি!’
Leave a Reply