দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে (ইউএনজিএ) অধ্যাপক ইউনূসের অংশগ্রহণ তার সরকারের জন্য একটি বড় সুযোগ করে দেবে।
তিনি বলেন, অধিবেশনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোন কোন ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে তা জানানোর সুযোগ হবে।
ওয়াশিংটন ডিসির উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক কুগেলম্যান রাইট টু ফ্রিডম-আর২ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
কুগেলম্যান বলেন, ‘যদি তিনি তা করেন (অধিবেশনে অংশগ্রহণ), তাহলে তিনি নিউইয়র্কে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে বক্তব্য দেবেন।’
তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস বেশ কিছু কাজ করতে পারতেন, বেশ কিছু কথা তিনি বলতে পারতেন।
আমি মনে করি, ‘সর্বোপরি তার উচিত দেশ পরিচালনার জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্য, সংস্কারের জন্য তার পরিকল্পনা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তার প্রচেষ্টা তুলে ধরা।’
রাইট টু ফ্রিডম বোর্ডের সদস্য জন ড্যানিলোউইজের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারের সঞ্চালনায় রাইট টু ফ্রিডমের নির্বাহী পরিচালক মুশফিকুল ফজল আনসারী প্যানেলের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেন এবং আরটুএফ’র বোর্ড প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদূত (অবসরপ্রাপ্ত) উইলিয়াম বি মিলাম উদ্বোধনী বক্তব্য দেন।
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নতুন যাত্রার সমালোচনামূলক দিক নিয়ে ওয়েবিনারে বক্তব্য দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সিটিজেনস ফর গুড গভর্নেন্সের সেক্রেটারি ড. বদিউল আলম মজুমদার।
কুগেলম্যান বলেন, তিনি মনে করেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মানবিক চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যু নিয়ে আলোচনার সুযোগ করে দেবে ইউনূসকে।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা বা আরও আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য একটি ক্ষেত্র তৈরি করা তার পক্ষে কার্যকর হবে, যা দুটি কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবে।’
এর একটি হলো- মিয়ানমারে যুদ্ধ বড় আকারে তীব্রতর হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নতুন করে আসতে দেখা গেছে।
দ্বিতীয়ত, গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধসহ অন্যান্য স্থানের যুদ্ধের কারণে দাতাদের দৃষ্টি অন্যত্র আকৃষ্ট হয়েছে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘তাই আমি মনে করি রোহিঙ্গা সংকট, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক মনোযোগ এবং দাতাদের সমর্থন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পেয়েছে, তবে এখনও একটি ঝুঁকি রয়েছে যা এটি এড়ানো যেতে পারে। তাই আমি মনে করি, অধ্যাপক ইউনূসের জন্য এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সম্মেলন সত্যিই একটি ভালো সুযোগ।’
কুগেলম্যান বলেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য পররাষ্ট্রনীতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে না।
সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হবে আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সংস্কারসহ অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, ‘তার মানে এই নয় যে এখনই জরুরি পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার নেই। আছে, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক।’
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কীভাবে দেখবে, তা নিয়ে কথা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, সরকারের পররাষ্ট্রনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর সুবিধা এবং অসুবিধা উভয়ই রয়েছে।
সুবিধার দিক থেকে, এর পক্ষে যা আছে, ইউনূস ফ্যাক্টর। ‘আমি মনে করি এটি এমন একটি বিষয় যা আমাদের এখানে তুলে ধরা করা দরকার। বিদেশের মাটিতে তারকা তিনি। তিনি একটি ঘরোয়া নাম। তিনি গভীরভাবে শ্রদ্ধার পাত্র। বিশ্বের মনোযোগ বা বিশ্বের সম্মান পেতে তাকে সত্যিই খুব বেশি পরিশ্রম করতে হবে না।’
তিনি আরও বলেন, বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতার যুগে বাংলাদেশ একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি এবং জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ।
কুগেলম্যান বলেন, ‘এর অর্থ হলো বিশ্বের বেশিরভাগ অংশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে জড়িত হতে চাইবে।’
বাংলাদেশে এখনও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে এবং এটি এমন একটি বিষয় যা অনেক বিশ্ব নেতা এবং অর্থনীতিকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে এবং অব্যাহত রাখবে।
কুগেলম্যান বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কয়েক সপ্তাহ আগের চেয়ে এখন আরও স্থিতিশীল হতে পারে, তবে নাজুক রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এটি এমন একটি বিষয় যা বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের ওপর প্রভাব ফেলবে, অন্যদের ওপর, তারা এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে কীভাবে দেখছে।’
সর্বোপরি তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিস্তৃত বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করা খুবই উপকারী হবে।
কুগেলম্যান বলেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং এর বিস্তৃত অংশীদার রয়েছে।
এর মধ্যে চীন ও জাপানের মতো বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষক সংস্থাও রয়েছে। এর মধ্যে ইইউ এবং অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মূল বাণিজ্য অংশীদাররা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যান্য বিষয়গুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি সরবরাহকারীরাও অন্তর্ভুক্ত।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক হওয়ার প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি এটি এখন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা।’
কুগেলম্যান বলেন, উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশকে খুব দৃঢ়ভাবে দেখাতে হবে যে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে তারা সঠিকভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে।
অধ্যাপক ইউনূস পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে পরিচিত হওয়ায় তিনি এক্ষেত্রে সুবিধা পেতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমি মনে করি, বাংলাদেশ সরকারকে সত্যিকার অর্থে দেখাতে হবে তারা সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর ড. ইউনূসের কথা বলতে গেলে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি খুব শিগগিরই ইউএনজিএ’র বৈঠকে একটি বড় সুযোগ পাবেন, যেখানে তিনি যোগ দেবেন বলে আমি ধারণা করছি।’
ইউএনবি নিউজ
Leave a Reply