সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২০ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১)

  • Update Time : রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

জীবনকথা

আজ রোগশয্যায় বসিয়া কতজনের কথাই মনে পড়িতেছে। সুদীর্ঘ জীবনের পথে কতজনই আসিয়াছে আবার কতজনই চলিয়া গিয়াছে। কেহ দূরে চলিয়া গিয়াছে। কেহ চিরজনমের মতো পৃথিবী হইতে বিদায় লইয়া গিয়াছে। সকলের কথা আজ ভালো করিয়া মনে নাই। কিন্তু তাহাদের কেহ কেহ আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিতেছে। যাহারা দূরে চলিয়া গিয়াছে, যাহারা মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িয়াছে, তাহারা সকলেই আমার মানসলোকে নিত্য যাওয়া-আসা করিয়া আমার সঙ্গে যোগ-সংযোগ করিতেছে। কত বিগত দিনের সুখস্মৃতি বহিয়া আনিয়া তাহারা আমার মনে কল্পনার জাল বোনে, দুঃখের দিনে সান্ত্বনার বাণী শুনাইয়া যায়।

 

ভাবিয়াছিলাম, ইহাদের কথা একদিন মনের মতো করিয়া লিখিব। আজ রোগশয্যায় বসিয়া মনে শঙ্কা হইতেছে যদি সারিয়া না উঠি, আমারই সঙ্গে তাহারাও চিরজনমের মতো বিস্মৃত হইয়া যাইবে। তাই যেমন করিয়াই হোক তাহাদের কথা লিখিয়া রাখি।

 

জীবনের সুদূর অতীতের প্রথম পটভূমিতে যতদূর দৃষ্টি যায় চাহিয়া চাহিয়া দেখি। এই আলো-আঁধারের দেশে কতক বোঝা যায় কতক বোঝা যায় না, ভাসাভাসা কয়েকটি ছবি আমার মনে উদয় হয়। মেঘলা দিনে ঘরের মেঝেয় নকশি কাঁথা মেলিয়া ধরিয়া মা সেলাই করিতেছেন আর গুনগুন করিয়া গান গাহিতেছেন।

 

বাজান রাত ভোর না হইতেই উঠিয়া নামাজ পড়িতেছেন। তাঁর কণ্ঠে নামাজের সুরাগুলি যেন আমার আধ-ঘুমন্ত বালকমনে কি এক অপূর্ব অনুভূতি আনিয়া দিতেছে যা কোনোদিনই ভাষায় কহিয়া বুঝাইতে পারিব না।

 

দরজায় দাঁড়াইয়া এক ফকির, আতশি পাথরের মালা গলায় পরিয়া ইউসুফ জুলেখার পুঁথি সুর করিয়া গাহিতেছে।

 

সারা গায়ে ধূলি-কাদা মাখিয়া সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরিয়াছি। মা ধরিয়া লইয়া গা ধুয়াইয়া আঁচল দিয়া মুছিয়া দিতেছেন।

 

আকাশ জুড়িয়া ঝড়ের দাপাদাপি। শব্দ করিয়া বজ্র ডাকিতেছে। বিছানায় শুইয়া বাজানের গলা জড়াইয়া ধরিয়াছি।

 

সারাদিন মেঘলা আকাশ। সামান্য সামান্য বৃষ্টি হইতেছে। কাছারিঘরে মেজো চাচা সুর করিয়া পুঁথি পড়িতেছেন। কি পড়িতেছেন বুঝিবার বয়স তখনও হয় নাই। বৃষ্টির সুরের সঙ্গে পুঁথি পড়ার সুর মনের মধ্যে যেন কি এক উদাসীনতা আনিয়া দিতেছে।

 

রূপা মল্লিকের বোন জানকী রঙিন শাড়ি পরিয়া আমাদের বাড়ি বেড়াইতে আসিয়াছে। তার হাসিমুখে যেন হলুদের ডুগুডুণ্ড। রূপে সারা আঙিনা ঝলমল করিতেছে।

এমনি কয়েকটি ছোট ছোট ঘটনা আমার মনের পর্দায় আসিয়া ছবি হইয়া ফুটিতেছে। অনেক বড় বড় ঘটনা ভুলিয়া গিয়াছি। কিন্তু এগুলি অবসর পাইলেই আমার মনের নাট্যমঞ্চে আসিয়া খেলা করিয়া যায়।

খুব আবছা আবছা মনে পড়িতেছে, আমাদের দু’খানা খড়ের ঘর। চারিধারে নলখাগড়ার বেড়া। চাটাই-এর কেয়ার বা ঝাঁপ বাঁধিয়া ঘরের দরজা আটকানো হয়। সেই ঘরের অর্ধেকখানিতে বাঁশের মাচা। মাচায় ধানের বেড়ি, হাঁড়ি, পাতিল থরে থরে সাজান। সামনে সুন্দর কারুকার্যখচিত বাঁশের পাতলা বাখারি দিয়া নকশা করা একখানি ঝাঁপ টাঙানো। ইচ্ছামতো সেই ঝাঁপ উঠাইয়া মাচায় যাওয়া যায়। মাচার কাজ সারিয়া ঝাঁপটি ছাড়িয়া দিলে উহা সমস্ত মাচাটিকে ঘরের মেঝে হইতে আলাদা করিয়া রাখে। বাঁশের পাতলা বাখারির ফাঁক দিয়া সমস্ত মাচাটিকে দেখা যায়। এই ঘরের মেঝেতে সপ বিছাইয়া আমরা শুইয়া থাকিতাম। শীতের সকালে নলখাগড়ার বেড়ার ফাঁক দিয়া লম্বা লম্বা রোদের রেখা আমাদের ঘরে প্রবেশ করিত। সেই রোদ-রেখার উপর দিয়া গুঁড়ো গুঁড়ো ধূলিকণা নানা ভঙ্গি করিয়া যাওয়া-আসা করিত। বিছানায় শুইয়া আধঘুমন্ত চোখে তাহা দেখিয়া দেখিয়া কতরকমের কল্পনাই না মনে আঁকিতাম। মাঘ-মাসে আমাদের ঘরের পাশে বরই গাছে বরই পাকিত। শেষরাত্রে ঘুম ভাঙিলে টুব টুব করিয়া বরই পড়ার শব্দ শুনিতাম। সেই শব্দে আমার বুকের ভিতর যেন কেমন করিত।

ঘরের সামনে ছিল প্রকাণ্ড উঠান। তার দক্ষিণ দিকের অংশ ছিল আমার পিতার চাচাতো ভাইদের। উত্তর দিকের অংশ ছিল আমাদের। বাড়ির উত্তর দিকে ঘন বিজে-কলার বাগান।

কোনো কোনো দিন কলার পাতায় বাতাস দোলা দিত। আমার বালকমন সেই শব্দে কোথায় উদাস হইয়া যাইত।

আমাদের উঠানে বারো মাসে বারো ফসল আসিয়া রঙের আর শব্দের বিচিত্র খেলা খেলিত।

আমার পিতাকে আমরা বাজান বলিয়া ডাকিতাম। বাজানের ছেলেবেলার খবর আমার বিশেষ জানা নাই। আমাদের পড়াশুনায় অবহেলা দেখিলে তিনি বলিতেন, আজকালকার ছেলেরা তেমন পড়াশুনা করে না। আমরা আগে কত পড়িতাম। রাত্র দশটা পর্যন্ত তো পড়িতামই, আবার শেষরাত্রে উঠিয়া বইপুস্তক লইয়া বসিতাম। কেরোসিনের কুপিতে পড়াশুনা করিলে চোখ নষ্ট হয়। বন-জঙ্গল হইতে তাই রয়নার ফল পাড়িয়া আনিতাম। মা সেই ফল ঢেঁকিতে কুটিয়া পানিতে জ্বাল দিয়া তৈল বাহির করিয়া দিতেন। আমরা সেই তৈলে প্রদীপ জ্বালাইয়া পড়াশুনা করিতাম।

বাজান ঘর-সংসারের কাজ ফেলিয়া স্কুলে যাওয়া-আসা করিতেন বলিয়া আমার দাদা ছমিরউদ্দীন মোল্লা বাজানের উপর বড়ই চটা ছিলেন। বাজান তাঁর একমাত্র পুত্র। বৃদ্ধ বয়সে তিনি সংসারের সমস্ত কাজ দেখাশুনা করিতে পারিতেন না। কোনো কঠিন কাজ করিতে কষ্টসাধ্য হইলে তিনি বাজানকে খুব গালমন্দ করিতেন।

চলবে…….

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024