জীবনকথা
তাই বাজান অবসর পাইলেই দাদার সাংসারিক কাজে সাহায্য করিতেন। হয়তো সেইজন্যই তাঁহাকে শেষরাত্রে উঠিয়া পড়াশুনা করিতে হইত। বর্ষাকালে আমাদের দেশে সমস্ত মাঠ ঘাট জলে ডুবিয়া যাইত। গরুর জন্য কোথাও ঘাস মিলিত না। বাজান তাঁর সহপাঠী কাজেম মোল্লাকে সঙ্গে লইয়া পদ্মা নদীর ওপার হইতে মাঝে মাঝে নটা-ঘাস কাটিয়া আনিতেন। একবার তাঁহারা পদ্মা নদীর ওপার হইতে নৌকার নটা-ঘাস বোঝাই করিয়া এপারে আসিতেছেন, মাঝনদীতে আসিয়া নৌকা ডুবিয়া গেল। শালকাঠের নৌকা না হইলে প্রায় সকল নৌকাই নদীতে ডুবিলে ভাসিয়া থাকে। সেইজন্য মুরব্বিরা উপদেশ দিতেন, নদীর পাড়ি যদি অনেক দূরের হয় তবে নৌকা ডুবিলেও নৌকা ছাড়িয়া যাইও না। নৌকা ডুবিলেও তাহাতে বাঁশ, কাঠ প্রভৃতি ভাসমান অনেক জিনিস থাকে। তাহা অবলম্বন করিয়া কিনারে আসিতে চেষ্টা করিও।
সুখের বিষয় বাজান আর তাঁর বন্ধু যে নৌকায় আসিতেছিলেন তাহা ডুবিয়া গেলেও পানিতে ভাসিতে লাগিল। অথই পদ্মার জলে তাঁহারা সেই ভাসমান নৌকা ধরিয়া রহিলেন। বাতাসে ভাসিতে ভাসিতে তাঁহারা জনমানবহীন পদ্মার চরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চারিদিকে নটা-ঘাসের জঙ্গল। সেখানে নটা-ঘাসের পাতায় বাবুই পাখিরা বাসা করিয়াছে। নানারকমের রাশি রাশি পিঁপড়ে নটা-ঘাসের ডগা ধরিয়া তাহার রস খাইতেছে।
এইসব স্থানে কুমির আসিয়া আস্তানা গাড়ে। জলবোড়া সাপ এখানে-সেখানে ঘুরিয়া বেড়ায় বাবুই পাখির ডিমের লোভে। দুই বন্ধু সেই নটা-ক্ষেতে লগি গাড়িয়া তাহার মাথায় গামছার ফরা উড়াইয়া দিলেন; দূর হইতে যদি কেহ আসিয়া তাঁহাদের উদ্ধার করে। খানিকটা দূরে দুই-তিনখানা জেলে-নৌকা চলিয়া গেল। তাঁহারা এত ডাকাডাকি করিলেন, জেলেরা ফিরিয়াও চাহিল না। জেলেরা বস্তুত জলে ডোবা লোকদের উদ্ধার করিতে বড় একটা আসে না। তাহারা নদীতেই প্রায় কাটায়। এমনি জলে ডোবা নৌকা তাহারা সচরাচর দেখিতে পায়। তাহাদের উদ্ধার করিতে গেলে মাছ ধরার সময় তাহারা কোথায় পাইবে? তাহারা তো গরিব। মাছ না ধরিতে পারিলে জেলের পরিবার অনাহারে থাকিবে।
ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। লগি অবলম্বন করিয়া দুই বন্ধু প্রমাদ গনিলেন। রাতে তাঁহাদের উদ্ধার করিতে কেহই আসিবে না। নটা-ক্ষেতে কুমিরের ভয়-সাপের ভয়। এমনি চুপ করিয়া থাকিলে কুমির আসিয়া লইয়া যাইবে। তাঁহারা লগি উঠাইয়া মাঝে মাঝে সেই নটা-ক্ষেতে বাড়ি মারিতে লাগিলেন। শীতে সমস্ত দেহ কোঁকড়াইয়া আসিতেছে। বিপদের রাত্র কিছুতেই কাটিতে চাহে না। কিন্তু তাঁহাদিগকে এই বিপদ হইতে উদ্ধার হইতেই হইবে। শরীর গরম করিবার জন্য দুই বন্ধু জড়াজড়ি করিয়া একে অপরকে আলিঙ্গন করিয়া রহিলেন, আর মাঝে মাঝে লগি দিয়া নটা-ঘাসের উপর বাড়ি মারিতে লাগিলেন।
এইভাবে রাত শেষ হইয়া আসিল। একখানা গৃহস্থ নৌকা সামনে দিয়া যাইতেছিল। তাঁহারা আসিয়া দুই বস্তুকে নৌকায় তুলিয়া লইলেন। তখন তাঁহাদের শরীরের চামড়া কুঁচকাইয়া বিয়াছে। আভন স্থালিয়া কিঞ্চিৎ সেভ দিয়া সেই নৌকার লোকেরা তাঁহাদিগকে এপারে আসিয়া নামাইয়া দিল।
বাজান ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ। আজানুলম্বিত বাহু আর স্বাস্থ্যবান দেহের উত্তরাধিকারী। মুখজরা ছিল সুন্দর দাড়ি। তিনি ধুতি পরিয়া মাথায় টুপি রাখিতেন। পাঞ্জাবিতে গা আবৃত কারিয়া ‘একপাটা’ নামক পাতলা এক প্রকার চাদর কাঁধে জড়াইতেন। শীতকালে গরন আলোয়ান গায়ে দিতেন। ছাতিও তখন পোশাকের অন্তর্গত ছিল। যখন রৌদ্র বৃষ্টি থাকিত না তখনও হাতে ছাতি না লইয়া তখনকার ভদ্রলোকেরা ঘরের বাহির হইতেন না। বাজানের প্রৌঢ়কালে ধর্মীয় নব আন্দোলনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে ধুতির স্থানে পা-জামা, লুঙ্গি ও পাঞ্জাবির উপরে আচকান পরার প্রচলন হইয়াছে। মুখের দাড়ি ও মাথার টুপি আজ আধুনিক মুসলমানদের মধ্যে কচিৎ দেখা যায়।
বাজান ছোটবেলায় স্কুলে ভর্তি হইয়া ইংরেজি বাংলা উভয় ভাষাই শিক্ষা করিতেছিলেন। ওহাবী আন্দোলনের জের তখনও থামে নাই। ইংরেজ তাড়াইতে না পারিয়া তখনকার মুসলমানেরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রুচি অনুসারে সমাজসংস্কারে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। হাজী শরিয়তুল্লার মৃত্যুর পরে তাঁহার পুত্র দুদুমিয়া সাহেব সুবে বাঙলার খলিফা হইলেন। মাওলানা কেরামত আলীর দল তখন ইংরেজদের সঙ্গে রফা করিয়া তাঁর শাকরেদদিগকে ইংরেজি পড়ার অনুমতি দিয়াছেন। দুদুমিয়া কিন্তু টলিলেন না। তাঁর আদেশে একদিনে দশ-বারোটি নীলকুঠি জ্বলিয়া ছাই হইয়া গেল।
Leave a Reply