জীবনকথা
অধুনা যেখানে মুরগির হাট তাহার পিছনে সাহাদের আরও একটি ঘর ছিল। প্রায় খালিই পড়িয়া থাকিত। সাহাদিগকে অনেক বুঝাইয়া সেই গুদামঘরে স্কুল স্থানান্তরিত হইল। সুরেশবাবুর সঙ্গে বাজানের গভীর বন্ধুত্ব স্থাপিত হইয়াছিল। এই স্কুলটিকে অবলম্বন করিয়া তাঁহারা একে অপরকে বড়ই আপনার করিয়া লইয়াছিলেন। একত্র হইলে পরস্পরের দুঃখ দারিদ্র্য বা সাংসারিক অনটনের কথা লইয়া কোনোদিন তাঁহাদিগকে আলোচনা করিতে শুনি নাই। তাঁহাদের চাইতেও অসহায় দীনহীন এই স্কুলটির দুরবস্থার মধ্যে তাঁহারা নিজেদের অভাব অনটন লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন। ক্রমে স্কুলের অবস্থা কিছু ভালো হইল।
একবার বাজানের খুব অসুখ হইল। সুরেশবাবু ফরিদপুর শহর হইতে দুই মাইল পথ হাঁটিয়া রোজ বাজানকে দেখিতে আসিতেন। বাজান সারিয়া উঠিলেন। সুরেশবাবুকে সামান্য কি ম্যালেরিয়া জ্বরে ধরিল। সেই জ্বরেই তাঁহাকে মৃত্যুর দেশে লইয়া গেল। তাঁহার মৃত্যুর পরে বাজান একেবারে ডানাভাঙা পক্ষীশাবকের মতো হইয়া গেলেন। সুরেশবাবুর মতো এমন আদর্শবাদী শিক্ষক কোথায়ও দেখা যায় না। যাহারা তাঁহার নিকট পড়াশুনা করিয়াছে তাহারা কোনোদিন তাঁহার স্নেহ-মমতার কথা ভুলিবে না। তিনি শুধু শিক্ষকই ছিলেন না, তাঁর ছাত্রদের তিনি নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসিতেন। সুরেশবাবুর মৃত্যুর পর তাঁর ছোটভাই উমেশবাবু আসিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করিলেন। তিনিও তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতোই আদর্শবাদী ছিলেন। এরপর এই স্কুল নানা স্থানে ঘুরিল। ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ মোক্তার মৌলবি আবদুল গণি সাহেব নিজের বৈঠকখানায় স্কুলের স্থান সঙ্কুলান করিলেন। তারপর ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ লোকহিতৈষী, পরে কংগ্রেসনেতা, ডাক্তার সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই স্কুলের সমস্ত ভার গ্রহণ করিলেন। তিনি ডাক্তারি করিয়া যাহা পাইতেন সমস্তই দান-খয়রাত করিয়া দিতেন। এই সময়ে স্কুল আলীপুরের একটি ভাড়াবাড়িতে স্থানান্তরিত হয়।
গত প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সুরেশবাবু যুদ্ধে চলিয়া যান। তারপর নানা হাত ঘুরিয়া স্কুলটি থানার দক্ষিণে একটি ভাড়াবাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। এখনও স্কুলটি সেখানেই আছে। দিনে দিনে স্কুলের ছাত্রসংখ্যা বাড়িতে থাকে। সেইসঙ্গে শিক্ষকের সংখ্যাও বাড়িয়াছে।
এই সময়ে আমাদের সাংসারিক অবস্থা বেশ সচ্ছল ছিল। আমার পিতা স্কুল হইতে মাত্র ১৫টি টাকা মাসে বেতন পাইতেন। ইহা লোকের কাছে বলিতেও লজ্জা করে। তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁহার অধীনে যে কেরানি কাজ করিতেন তিনিও মাসে ৩০ টাকা করিয়া বেতন পাইতেন। আমরা বাজানকে স্কুলের কাজ হইতে অবসর লইতে বলিতাম কিন্তু তিনি তাহা কিছুতেই শুনিতেন না। তিনি বলিতেন, মাসে পনেরোটি করিয়া টাকা পাই, ইহাতে বাড়ির নুন, তেল কেনার খরচ হয়। ইহা তাঁহার অন্তরের কথা নহে। এখন আমাদের অবস্থা ভালো। আমি চাকরি করিয়া যথেষ্ট টাকা সংসারে দেই। তাহা ছাড়া পদ্মায় চর পড়িয়া আমার পিতা অনেক নতুন জমিজমার অধিকারী হইয়াছেন। নিজের জমিজমা দেখাশুনা করিলে এবং প্রজাদের খাজনাপত্র আদায় করিলে অনেক বেশি টাকা তাঁহার আয় হইত। প্রকৃতপক্ষে বাজান স্কুলের কাজে ছিলেন বলিয়া এদিকে অনেকটা বিশৃঙ্খল হইয়া পড়িয়াছিল। সময়মতো তাগিদ না দেওয়াতে প্রজারা প্রায়ই খাজনা বাকি ফেলিত। জমিজমার ফসলও ঠিকমতো বাড়ি আসিত না। আমরা মনেপ্রাণে কামনা করিতাম বাজান আর স্কুলের কাজ না করেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই স্কুল ছাড়িবেন না। আসল কথা, প্রায় ৩৫/৩৬ বৎসর পর্যন্ত ছেলেদের সঙ্গে কাটাইয়া শিক্ষকতার কাজ তাঁহার জীবনের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছিল। যেসব ছোট ছোট ছেলেদের তিনি প্রতিদিন পড়াইতেন তাহাদের মায়ায় তিনি নিজেকে জড়াইয়া ফেলিয়াছিলেন। একদল উপর শ্রেণির ছেলেরা পাশ করিয়া যখন স্কুল ছাড়িয়া যাইত তখন তাহাদের সঙ্গে বাজানও চাদরের খোঁটায় চোখের পানি মুছিতেন। কিন্তু অল্পদিনে নূতন ছাত্রদল আসিয়া তাহাদের শূন্যস্থান পূরণ করিত। তাঁহার পুরাতন ছাত্রেরা যখন পথে-ঘাটে কোথাও তাঁহার সঙ্গে দেখা করিয়া তাঁহাকে সালাম করিয়া শ্রদ্ধা জানাইত, তিনি তাহাতে বড়ই গৌরব অনুভব করিতেন। তাঁহার কোন ছাত্র বি এ পাশ করিয়া বাজারের মধ্যে দেখা হইলে বহুলোকের সামনে তাঁহাকে পায়ে হাত দিয়া সালাম করিয়াছিল এই ঘটনাটি কত ঘটা করিয়া তিনি মায়ের কাছে বলিয়াছিলেন। শুধু কি মায়ের কাছে যেখানে যাহার সঙ্গে দেখা হইত সুযোগ বুঝিয়া তিনি এই ঘটনাটি বিবৃত করিতেন।
শুধু ছাত্রদের সঙ্গে নয়, এই স্কুলের প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে ছিল তাঁর প্রাণের মমতা। তাই এই স্কুল হইতে তাঁহাকে আমরা কিছুতেই ছাড়াইতে পারিলাম না। আমরা পারিলাম না কিন্তু আমার এক কায়স্থ বন্ধু সেই কার্যটি করিয়া দিলেন। তিনি যখন আমার সঙ্গে বি এ ক্লাসে পড়িতেন তখন প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসিতেন। আমার পিতা তাঁহাকে আমার বন্ধু বলিয়া বড়ই স্নেহ করিতেন। আমাদের বাড়ি আসিলে তাঁহাকে এটা-ওটা না খাওয়াই ছাড়িতেন না।
(চলবে)
Leave a Reply