শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৭)

  • Update Time : শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

জীবনকথা

হাওয়া সিন্নির পরদিন কদমতলা নামক এক জায়গায় মেলা বসিত। সেই মেলায় খেলনা পুতুল, সিকা, নকশি-কাঁথা প্রভৃতি নানারকমের পল্লী শিল্পের নিদর্শনগুলি বিক্রি হইত। তাহা ছাড়া সারারাত্র ভরিয়া নানারকমের জারি, বিচার, যাত্রা, গাজীর গান প্রভৃতি বহু রকমের গ্রাম্যগানের আসর বসিত। এই মেলায় গ্রামবাসীরা যার যার গুণপনার পরিচয় দিয়া শত শত লোকের বাহবা পাইত। মেলা শেষ হইলে আবার এক বৎসর ধরিয়া গুণীজনেরা এই মেলায় আপনাপন কৃতিত্ব দেখাইবার জন্য অবসর সময়ে নিজ নিজ গুণপনার অনুশীলন করিত। শুনিয়াছি আমার দাদার চাচাতো ভাই জহিরউদ্দীন মোল্লার আমলে হাওই সিন্নির অনুষ্ঠান হইতে ভারে ভারে এত খই মুড়ি লাড্ডু ও কলা আসিত যে তাহা ১২/১৩ দিন খাইয়াও ফুরাইত না। পরে সেগুলিকে গরু দিয়া খাওয়ানো হইত। আধুনিক কালে নুরুল্লাপুর সানাল ফকিরের বাড়িতে লক্ষ্মী পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায় হাওয়া-সিন্নির অনুষ্ঠান হইয়া থাকে। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে আগের মতো তেমন জাঁকজমক নাই। সেকালে আশ্বিন, কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিনে গাস্বী উৎসব হইত। হিন্দুরা আশ্বিন মাসের শেষ দিনের আগের রাত্রে এই উৎসব করে। মুসলমানেরা তার পরের রাত্রে গাস্বী করে। কথায় বলে-

আশ্বিনে রান্দে কার্তিকে খায়,

যে বর মাঙে সেই বর পায়।

আজও গ্রামদেশে মুসলমানদের মধ্যে গাস্বী জাগানোর প্রচলন আছে। আমরা ছেলেবেলায় সারা বৎসর এই গাস্বীর দিনটির প্রতি চাহিয়া থাকিতাম। সারাদিন এ-বন ও-বন ঘুরিয়া তেলাকুচের পাতা, আমগুরুজের লতা, হলদি, পানের গাছ, বড়কচুর পাতা প্রভৃতি সংগ্রহ করিতাম। তাহার পর উঠানের এক জায়গা ভালোমতো লেপিয়া সারাদিনের কুড়ানো সামগ্রীসহ তালের আঁটি ও একটি নারিকেল, পান-সুপারি, সুন্দা-মেথি, কাজল তুলিবার জন্য কলার ডাঁটা প্রভৃতি একটি বড় কচুর পাতার উপর রাখিয়া আর একটি কচুপাতা দিয়া ঢাকিয়া রাখিতাম। শেষরাত্রে উঠিয়া আগুন জ্বালাইয়া আগুনের চারিদিকে ঘুরিয়া মশা তাড়ানোর মন্ত্র পড়িতাম। মন্ত্রটি ভালোমতো মনে নাই।

“যা যা মশা মাছি উইড়া যা, আমাগো বাড়িত্যা অমুকের বাড়ি যা।” সেই অমুকের বাড়ি বলিতে আমাদের খেলার যাহারা প্রতিদ্বন্দ্বী তাহাদের নাম জোরে জোরে বলিতাম। তাহারাও আবার মন্ত্র পড়িবার সময় আমাদের নাম করিত। গান্ধীর রাত্রে আমরা যে-গাছে ফল ধরে না একটি কুড়াল লইয়া সেই গাছে দু’একটি কোপ দিতাম আর বলিতাম, “এই গাছে ফল ধরে না, এই গাছ আজ কাটিয়াই ফেলিব।” আর একজন যাইয়া বলিত, “না না কাটিস না। এ বৎসর গাছে ফল ধরিবে।” তখন নিরস্ত হইতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিল এরূপ করিলে গাছে ফল ধরিবে। গাঙ্গীর রাত্রে গ্রামের যাহারা মন্ত্র-তন্ত্র জানে তাহারা সারারাত জাগিয়া সেই মন্ত্র-তন্ত্র আওড়াইত। তাহাদের বিশ্বাস ছিল এরূপ করিলে সেই মন্ত্র-তন্ত্র ফলদায়ক হইবে। অনেকের বাড়িতে সারারাত্র গান হইত। আস্তে আস্তে ভোরের আসমান রঙিন করিয়া সূর্য উঠিত। আমরা তখন সেই সুন্দামেথি, আমগুরুজের লতা, তেলাকুচের পাতা ও হলদি পাটায় বাটিয়া সারা গায়ে মাখিয়া নদীতে স্নান করিতে যাইতাম। ফিরিয়া আসিতে কলার ডাঁটার কাজল করিয়া মা আমাদের চোখে কাজল পরাইয়া দিতেন। তারপর তালের শাঁস, নারিকেল গুড়, আর চিড়ামুড়িসহ অপূর্ব নাস্তা করিয়া পাড়ায় বেড়াইতে যাইতাম। নইমদ্দী মোল্লার বাড়ির হালটে কুস্তি ও হাডুডু খেলা হইত। নদীর ওপারে চরে লাঠিখেলা হইত।। তাহা দেখিয়া দুপুরে বাড়ি ফিরিতাম। বাড়িতে সেদিন ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হইত। গাস্বীর পরদিন বড়রা বিলে ঝিলে পলো লইয়া মাছ ধরিতে যাইত। গাছিরা অন্তত একটি খেজুর গাছের ডগা কাটিয়া ভবিষ্যতে রস বাহির করার ব্যবস্থা করিত।

এদেশে হিন্দু-মুসলমান বহুদিন একত্র বাস করিয়াও দুই সমাজ সমানে যোগ দিতে পারে এমন কোনো অনুষ্ঠান গড়িয়া তুলিতে পারে নাই। এই গাস্বী উৎসবের মধ্যে কোনো রকমের ধর্মীয় ব্যাপার নাই। এই উৎসবটিকে ভালোমতো সংগঠন করিয়া ইহাকে হিন্দু-মুসলমানের একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত করা যাইতে পারে।

আমার পরদাদার নাম ছিল আরাধন মোল্লা। একেবারে বাংলা নাম। আগেকার দিনে বহু মুসলমানের বিশেষ করিয়া বহু মেয়ের বাংলা নাম থাকিত। শুনিয়াছি আরাধন মোল্লা গ্রামদেশের প্রসিদ্ধ জোতদার ছিলেন। তাঁহার অবস্থা খুব ভালো ছিল। মাঠ ভরিয়া আখের ক্ষেত হইত, সেই আখ মাড়াইয়া, কলে পিষিয়া রস বাহির করিয়া গুড় জ্বাল দেওয়া হইত। হাজার হাজার মণ গুড় বাঁকে করিয়া বেপারীরা যখন আরাধন মোল্লার বাড়ি হইতে গঞ্জের হাটে যাইত, তাহা নাকি দেখিবার জন্য ঘরের বউঝিরা পর্যন্ত বাড়ির বাহির হইয়া আসিত। বাড়িতে অতিথি মুসাফির ফিরিয়া যাইত না। মুড়ির মোয়া নারকেলের নাড়ু কাছারিঘরেই বড় বড় কোলায় ভর্তি থাকিত। যারা খুশি আসিয়া খাইলেই হইল। নিজের ছেলেমেয়ে, জন-মানুষ মিলিয়া প্রতিবারে ২/৩ শত লোক তাঁহার বাড়িতে আহার করিত।

 

(চলবে)…….

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024