জীবনকথা
আরাধন মোল্লার মৃত্যুর পর পদ্মানদীতে আমাদের জমিজমা বাড়িঘর সব ভাসাইয়া লইয়া গেল। আমার দাদারা-কলিমদ্দীন মোল্লা, ছমিরদ্দীন মোল্লা আর দানু মোল্লা অন্যত্র যাইয়া বাড়ি করিলেন। ছমিরঙ্গীন মোল্লা আমার আপন দাদা। তিনি বড়ই সুপুরুষ ছিলেন। যৌবনকালে তাঁহার সুন্দর চেহারা দেখিয়া ঢোল সমুদ্দুরের মিএফ্লারা তাঁহাকে কন্যা দান করিয়াছিলেন। আমার দাদার অবস্থা ভালো ছিল না বলিয়া দাদির ভাইরা দিনে আমাদের বাড়ি বেড়াইতে আসিতেন না। রাত্রে গোপনে আসিয়া আমার দাদিকে দেখিয়া যাইতেন। আমার দাদি ছিলেন আগুনের ফুলকির মতো সুন্দরী। আমার খুব ছোট বয়সে তিনি এন্তেকাল করেন।
আগেকার দিনে পাড়ায় পাড়ায় গানের আসর বসিত। গাজীর গান, জারিগান, কেচ্ছাগানে সমস্ত গ্রাম মাতিয়া থাকিত। শহর তখনও দেশের গুণীজনকে আকর্ষণ করে নাই। গ্রামের শ্রেষ্ঠ গায়ক গ্রামেই থাকিত। মাঠ ছিল স্বর্ণপ্রসবা। সামান্য লাঙলের আঁচড় দিয়া বীজ ছড়াইয়া দিলেই সবুজ ধান্যের অঙ্কুরে দিগন্ত ছাইয়া যাইত। নদী খাল বিল কিলবিল করিত মাছে। হাত বাড়াইয়া ধরিয়া লইলেই হইল। টাকা-পয়সায় জিনিসপত্রের আদান-প্রদান খুব কমই হইত। বাৎসরিক ধানের বিনিময়ে ছুতোর মিস্ত্রি লাঙল গড়াইয়া দিয়া যাইত, নাপিত খেউরি করিয়া দিত, কুমার হাঁড়ি পাতিল দিয়া যাইত, তিল সরিষার বিনিময়ে কুলুরা বাড়িতে বাড়িতে তৈল দিয়া যাইত। এখনও গ্রামদেশে এইসব বিনিময়ের প্রথা কিছুটা বজায় আছে।
প্রত্যেক বাড়িতে দুগ্ধবৎসলা গাভী ছিল। যার গাভী ছিল না সে অপরের বাড়ি হইতে চাহিয়া দুষ লইতে পারিত। আমার অন্ধ-দাদা দানু মোল্লার কোলে বসিয়া আমি বালককালে এইসব পরিপূর্ণতার কাহিনি শুনিতাম। আমার নক্সীকাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট পুস্তকে আমি এই গ্রামবাংলার পরিবেশেরই চিন্তা করিয়াছি। আজও গ্রামদেশে পরিপূর্ণতার ছবি মনে মনে চিন্তা করিতে আমার ভালো লাগে। আজিকার এই অভাবভরা নিরানন্দ দেশের সঙ্গে নানা কুসংস্কারপূর্ণ ধনধান্যে আনন্দগানে ভরা দেশকে আমি সহজেই বিনিময় করিতে পারিলে আনন্দে নাচিয়া উঠিতাম।
ছোটবেলায় আমি বড়ই চঞ্চল ছিলাম। আমাদের বাড়ির চারিধারের সকলেই কৃষক।
তাহাদের ছেলেদের সঙ্গে পাড়া ভরিয়া খেলিয়া বেড়াইতাম। আমাকে কাপড় পরানো এক মুস্কিলের ব্যাপার ছিল। বহু বয়স পর্যন্ত আমি লেংটা ছিলাম। গ্রাম সম্পর্কে আমার এক দাদি আমার মাজায় ব্যাঙ বাঁধিয়া দিয়াছিলেন। তাহাতেও আমাকে কেহ কাপড় পরাইতে পারে নাই। ভাবি এখনও আমাকে ঠাট্টা করিয়া বলেন, “ক্লাস থ্রিতে যখন তুমি পড় তখনও দেখিয়াছি স্কুল হইতে আসিয়া ওই পথের মধ্যে তুমি পরনের কাপড়খানা মাথায় বাঁধিয়া বাড়ি ঢুকিতে।” জামাকাপড় পরা আমার কাছে একটি শাস্তির মতো মনে হইত। এখনও আমি ভালোমতো পোশাক-আশাক পরিতে পারি না বলিয়া বন্ধুজনের উপহাসের পাত্র হই। ইহার ফলে এই হইয়াছে যে ঠাণ্ডা ও গরম আমি যতটা সহ্য করিয়াও সুস্থ থাকি অপরে তাহা পারে না।
ছেলেবেলায় আমরা নানারকমের খেলা খেলিতাম। গ্রামে বিবাহে যেমনটি দেখিতাম তেমনি করিয়া আমরা বিবাহের উৎসব বসাইতাম। ওপাড়ার সাগরী, ময়না, নেহার ফুফাতো বোন মাজু, এরা বউ হইত। আমি, আমার চাচাতো ভাই নেহাজদ্দীন এবং গ্রামের আরও কেহ কেহ হইতাম বর। গাছের পাতার টুপি পরিয়া আমরা বর সাজিতাম। সেই টুপি আবার বরকেই গড়িয়া লইতে হইত। ইঁদুরের মাটির মিষ্টান্ন দিয়া বর ও কনের ক্ষীরভুজানি হইত।
(চলবে)……..
Leave a Reply