শশাঙ্ক মণ্ডল
দ্বিতীয় অধ্যায়
ডঃ নীহার রায়, সতীশ মিত্র প্রমুখ ঐতিহাসিকরা সমর্থন করেছেন গ্রিক নাবিকরা যে গাসে বন্দরের কথা বলেছেন তা বিদ্যাধরী নদীর তীরে চন্দ্রকেতুগড়। মনসামঙ্গলের চাঁদসদাগর বিদ্যাধরী দিয়ে চন্দ্রকেতুর রাজত্বে বাণিজ্য করতে আসতেন তা বিভিন্ন মনসামঙ্গল কাব্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। গঙ্গা নদী বয়ে চলত বর্তমান হুগলী নদী পথে কলকাতা পর্যন্ত, পরে আদি গঙ্গার প্রবাহপথে বর্তমানের টালীর নালা দিয়ে কালিঘাট, গড়িয়া, বারুইপুর, বিষ্ণুপুর, ডায়মন্ডহারবার, কাকদ্বীপ, মনসাদ্বীপের পাশ দিয়ে সাগরদ্বীপের নিকটে ছিল তার মোহনা। সাগর অভিমুখী গঙ্গার এই প্রাচীন প্রবাহপথের পাশের গ্রামগুলি ধর্মান্ধদের কাছে পবিত্র স্থান এবং বসবাসের জন্য বহু মানুষ এখানে সমবেত হতেন। আদি গঙ্গার প্রাচীনখাতের তীরবর্তী স্থানগুলিতে আজও বহু প্রাচীন ঘাট ও মন্দিরের ভগ্নাবশেষ লক্ষ করা যাবে। ২৪ পরগণার দক্ষিণাংশে মগরাহাট, বারুইপুর, জয়নগর, বিষ্ণুপুর খাড়ি প্রভৃতি এলাকায় অনেক পুকুর স্থানীয় মানুষরা গঙ্গা নামে অভিহিত করে এবং গঙ্গার জল হিসাবে পবিত্র ক্রিয়াকর্মে তা ব্যবহার করে।
সরস্বতী নদী বর্তমান পথে আন্দুল পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে হুগলী নদীর পথ ধরে রূপনারায়ণের সাঙ্গে মিশে যেত। বিখ্যাত তাম্রলিপ্ত বন্দর এই নদীপথের উপর অবস্থিত ছিল। ১৫০ খ্রীষ্টাব্দের বিখ্যাত ভৌগোলিক টলেমীর তাম্রলিতিস বন্দর এই তাম্রলিপ্ত। ‘শঙ্খজাতক’, ‘বাণিজ্যজাতক’ প্রভৃতি পুঁথিতে সেদিনকার বাণিজ্যের পরিচয় রয়েছে। এই বন্দরের সাঙ্গে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উক্ত পুস্তকগুলিতে উল্লিখিত হয়েছে। মোগল-পূর্ব যুগেও সরস্বতী ছিল বাণিজ্যের প্রধান জলপথ এবং পরবর্তীকালে এই নদীরতীরে গড়ে উঠেছিল ষোড়শ শতকের বাঙালির বিখ্যাত বন্দর সপ্তগ্রাম। পরবর্তীকালে সরস্বতীর ওপরের দিকে অনেকগুলি বাঁকের সৃষ্টি হওয়ায় নদী মজে যেতে থাকে।
ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি থেকে জাহাজ বা বড় নৌকার পক্ষে এই পথ পার হওয়া অসম্ভব হয়ে উঠত। শেষ পর্যন্ত পলি জমতে জমতে নদী শুকিয়ে গেলে জোয়ারের জলের ভরসায় নৌকা চলত। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে সপ্তগ্রাম বন্দরের মৃত্যু সূচিত হল। (৩) নবাব আলিবর্দী খাঁ খিদিরপুর থেকে সাঁকরাইল পর্যন্ত একটি খাল কেটে গঙ্গার সাঙ্গে সরস্বতীকে যুক্ত করেন ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে এবং তার ফলে আদিগঙ্গার স্রোত বন্ধ হয়ে গেল, কাটি গঙ্গা তীব্র হয়ে বর্তমানের হুগলী নদী গড়ে উঠল। মাত্র ৪০/৫০ বছরের মধ্যে আদিগঙ্গার বিশাল প্রবাহ শুকিয়ে এল। বাংলা সাহিত্যে ষোড়শ শতাব্দীর পরে অনেক কবি এই প্রাচীন পথের ছবি রেখে গেছেন। মনসামঙ্গলের কবি বিপ্রদাস পিপলাই তার মনসা বিজয়ে আদিগঙ্গার তীরবর্তী এ-সব স্থানের উল্লেখ করেছেন রাজঘাট ইন্দ্রঘাট নদীয়া আমবোয়া ত্রিবেণী সপ্তগ্রাম কুমারহাট হুগলী, ভাটপাড়া, বোড়ো, কাকিনাড়া, মূলাজোড়, নিমাইঘাট, চনক, রামনাম, আকনা, মহেশ, খড়দহ, রিষড়া, শুকচর, কোন্নগর, কোতরঙ, কামারহাটি, এড়িয়াদহ, যুবড়ি, চিৎপুর, কলকাতা বেতোড়।
এরপরে আদিগঙ্গার বালান্দা, কালীঘাট, চূড়াঘাট, জয়ঘাট, জয়ধলী, ধনস্থান, বারুইপুব, হাতিয়াগড়। কৃত্তিবাসের রামায়ণে ইন্দ্রেশ্বর ঘাট, মেরাতলা, নবদ্বীপ, সপ্তগ্রাম, আকনামহেশ ভারঘাট-এর উল্লেখ আছে। কবিকঙ্কন মুকুন্দরামও উল্লেখ করেছেন বাঙালি বণিকরা বহির্বাণিজ্যের জন্য সরস্বতী নদী পরিত্যাগ করে আদি গঙ্গার পথে যেতেন। এর কারণ অবশ্য সি. আর. উইলসন এ-ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন- আদিগঙ্গা তখন অনেক প্রশস্ত নদী ছিল- মগ জলদস্যুদের উৎপাত এই নদীপথে কম ছিল-এর তীরে অনেক সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে ওঠায় নৌচালনার অনেক সুবিধা বণিকরা পেতেন। (৫)
Leave a Reply