শশাঙ্ক মণ্ডল
দ্বিতীয় অধ্যায়
১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে মরিসনের নেতৃত্বে হিঙ্গলগঞ্জের নিকট গৌড়েশ্বর নদী ও কালিন্দীর মধ্যে সংযোগসৃষ্টিকারী এক খাল কাটা হল দুলদুলী ও সাহেবখালির মধ্যে উদ্দেশ্য কলকাতা, বরিশালের নদীপথের দূরত্ব কমানো। আরও একটা খাল কাটা হল, খুলনা জেলার কালীগঞ্জ থেকে বাঁশতলার মধ্যে। এই দুটি খাল কাটার ফলে গৌড়েশ্বর ও যমুনা নদীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হল। বিদ্যাধরী-মাতলার মৃত্যুর কারণ হিসাবে কলকাতার ময়লা জলকে দায়ী করা হয়। ১৮৩৩ সালের সার্কুলার-খাল এবং পরবর্তীকালের বামনঘাটা খালের জল পেয়ে বিদ্যাধরী কিছুটা প্রবল হয়ে উঠে কিন্তু পরবর্তীকালে কুলটি খালের দুইপ্রান্তে দুটি লকগেট বসানোর ফলে বিদ্যাধরীর ওপরের অংশ মজে যাওয়ায় বিদ্যাধরী ধীরে ধীরে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ল।
বিদ্যাধরীর দক্ষিণে মাতলা স্তিমিত হয়ে পড়ল। ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে কলকাতা কর্পোরেশনের সামনে সমস্যা দেখা দিল ময়লা জল নিষ্কাশনের। ধাপা লকগেট তৈরির সময়ে বিদ্যাধরীর অবনতি শুরু হয়। বামুনঘাটা থেকে কুলটি ১৫ মাইল লম্বা ভাঙড় খাল কাটার ফলে এবং দুইমুখে দুটি লকগেট বসিয়ে এই খালকে মজা খালে পরিণত করা হল। পরবর্তীকালের কেষ্টপুরের খাল বিদ্যাধরীর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করল- এক বিশাল এলাকা জলের তলায় চলে গেল। চাষীদের চোখের জলে গড়ে উঠল হাড়োয়া দেগঙ্গা রাজারহাট এলাকার মাছের ভেড়ীগুলি। ইংরেজ রাজত্বে ২৪ পরগণার বসিরহাট বারাসাতের অনেকগুলি নদী যেগুলি ইছামতী বিদ্যাধরীর শাখা হিসাবে চিহ্নিত ছিল তা মজে গেল।
ইছামতীর একটা শাখানদী শিকড়া কুলীন গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে বিদ্যাধরীর সাঙ্গে মিলত। প্রতিনিয়ত অসংখ্য যাত্রীবাহী নৌকা শিকড়া কুলীন গ্রামের পাশের নদীতে নোঙর করত। আর অতিথিদের ভয়ে কুলীন গ্রামের গৃহস্থেরা দুপুরে দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকত। দূরদেশের অতিথিরা কোন রকম আদর আপ্যায়ন না পেয়ে শিকড়ার কুলীনদের ‘হাড়িফাটা কুলীন’ অর্থাৎ অত্যন্ত কৃপণ কুলীন হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। সে নদীর কোন চিহ্ন নেই। বারাসাত মহকুমার হাবড়া দেগঙ্গার মধ্য দিয়ে বিখ্যাত পদ্মানদী বয়ে চলত তা বর্তমানে মজাখাতে পরিণত হয়েছে।
একটি প্রাচীন ফারসি পুঁথি অবলম্বনে রচিত মহম্মদ এবাদুল্লাহ সাহেবের ‘পীর গোরাচাঁদ’ কাব্যে এই পদ্মানদীর উল্লেখ করা হয়েছে এবং পদ্মার তীরবর্তী শালিকদহ এয়াজপুর কাঁসদহ দেউলিয়া চৌরাশি গ্রামগুলির উল্লেখ করা হয়েছে। পদ্মার বিশালত্ব কাব্যের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এভাবে পদ্মার উপরে গোরা ক্রুদ্ধ হয়ে কয়। এলাহি পদ্মার গর্ব যেন চূর্ণ হয়। শৃগাল কুকুরে তারে পার হয়ে যাবে গোরাই দিলেন শাপ শুনে লাগে ডর তিন ক্রোশ চৌড়া পদ্মা পড়ে গেল চর।
ইচ্ছামতীর অপর একটি শাখা যমুনা নামে দক্ষিণ-চাতরা চারঘাট, গোবরডাঙ্গার পাশ দিয়ে বয়ে যেত। ১৯৪০-৪২ পর্যন্ত এই পথে টাকী থেকে গোবরডাঙ্গা লঞ্চ চলত-আজ তা মজা খাতে পরিণত হয়েছে।
Leave a Reply