শশাঙ্ক মণ্ডল
দ্বিতীয় অধ্যায়
সে যুগে সুন্দরবনের নদীপথে খাদ্যশস্য, নানাধরনের বনজ সম্পদ, কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি পূর্ববাংলা থেকে নিয়ে আসা হত কলকাতায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগেও সুন্দরবনের এ-সব নদীতে দলবদ্ধভাবে ডাকাতি হত। ১৮৩০ এর পর ডাকাতি ও লুণ্ঠন কমে আসে। নদীতীরে থানাগুলি গড়ে উঠেছিল ডাকাতদের দমন করার প্রয়োজনে তাই সুন্দরবনের ব্যাপক এলাকার সমস্ত থানাই নদীতীরে তা আমরা লক্ষ করি। জমিদার, লবণ চৌকির সুপাররা, তাদের নিজ নিজ এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলার দায়িত্ব নিতেন। ব্রিটিশপূর্ব যুগ থেকে জমিদাররা নদীপথে টোল চৌকি বসিয়ে নৌকার মাঝিদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত। হুগলী নদীতে এ ধরনের ৬৩ টি টোল চৌকির কথা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে জানা যাচ্ছে।
১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে সুন্দরবন কমিশনার জমিদারদের বে-আইনীভাবে নৌকার কাছ থেকে জোর করে খাজনা আদায় বন্ধ করার ব্যাপারে তৎপর হন। (১১) সুন্দরবনের নদী- পথগুলির প্রশংসা করেছেন অনেক বিদেশী পর্যটক। নদীতীরে অসংখ্য নয়ন মনোহর ধনক্ষেত আম সুপারী বাগান, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে একই উচ্চতায় গভীর জঙ্গল সেই সাথে নদীগুলির সৌন্দর্য ও নৌপরিবহণের উপযুক্ততা সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন এরা। বিখ্যাত ভৌগোলিক রেনল বাংলার গাঙ্গেয় অঞ্চলের নদীগুলির সমীক্ষা করে এক মানচিত্র তৈরি করেন। তাঁর বিখ্যাত পুস্তক ‘মেমোয়ার অফ্ অ্যা ম্যাপ অফ্ হিন্দুস্থান’-এ সুন্দরবনের অভ্যন্তরের নদীপথের দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন।
দীর্ঘ তের বছরের চেষ্টার মধ্য দিয়ে মেজর রেনল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের নির্ভরযোগ্য মানচিত্র তৈরি করেন ১৭৬৪-৭৭ মধ্যে। কলকাতা থেকে পূর্ব বাংলার সংক্ষিপ্ততম নদীপথে আবিষ্কার করা ছিল এ-কাজের প্রধান অঙ্গ। গঙ্গা থেকে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত রেনলকে সাহায্য করেন মার্টিন আর পূর্বপ্রান্তে সমুদ্রতীর পরিমাপ করতে সাহায্য করেন রিচার্ডস। পরবর্তীকালে ১৮৩৪-৩৬ এর দিকে ক্যাপটেন হজেস্ নোয়াখালির নিকটবর্তী মোহনার চরগুলি পরিমাপ করেন। ১৮৬৪ সালে রিচার্ডস এর নেতৃত্বে পুনরায় সমুদ্রতীর বরাবর গঙ্গাসাগর থেকে মেঘনা পর্যন্ত পরিমাপ করা হয় এবং সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী পরিমাপ করা হল। ১৮৮১ খৃীষ্টাব্দে আবার গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকা পরিমাপ করা হল।
ব্রিটিশ রাজত্বে দুই শত বৎসর ধরে সমুদ্রতীরবর্তী গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকায় সুন্দরবনাংশে ভাঙা গড়া চলেছে। তবু মূল ভূ- খণ্ডের অবস্থান প্রায় একই অবস্থায় রয়েছে। ১৮৩৬ খৃীষ্টাব্দের সমীক্ষায় লক্ষ করা গেছে মূল ভূ-খণ্ডের পরিমাণ বেশ কিছুটা বেড়েছে- অন্যান্য সময়ের সমীক্ষার তুলনায়। কিন্তু পরবর্তীকালে সমুদ্র তীরভূমিকে গ্রাস করায় পূর্বের অবস্থানে এসে যায়। অর্থাৎ বিগত দুই শত বছর ধরে ভূ-খণ্ড ও সমুদ্রের লড়াইয়ে কোন জয়-পরাজয় ঘটেনি একই অবস্থানে রয়েছো১৩-এটা ব্রিটিশ আমলের সমীক্ষাগুলিতে ধরা পড়ে। অবশ্য পরবর্তী কালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সমকালে পশ্চিম সুন্দরবনের রায়মঙ্গল, হরিণভাঙ্গা নদীর মোহনার নিকটবর্তী এলাকাতে ভূমিগঠনের কাজ দ্রুত বেগে চলেছে। এবং এক বিশাল ভূখণ্ডসমুদ্রের অভ্যন্তরে জেগে ওঠার সম্ভাবনার কথা ডেনিশ মিশন স্কীমের সদস্যদের নজরে এসেছিল তা বর্তমানে বাস্তব রূপ নিতে চলেছে পূর্বাশা দ্বীপের মধ্য দিয়ে।
Leave a Reply