সারাক্ষণ ডেস্ক
সাম্প্রতিক বন্যা কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, সিলেট ও চট্টগ্রামে চরম মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সকল বেসরকারি সেক্টরের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার পরেও স্বাস্থ্য খাতে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। খাদ্যাভাব এবং বন্যার প্রাথমিক সংকট কেটে গেলেও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে বিশেষ নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ব্র্যাক এবং ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারজ (ইউএইচসি) ফোরামের যৌথ উদ্যোগে আজ বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে “বন্যা পরবর্তী স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতার নিরিখে করণীয় নির্ধারণে বহুপক্ষীয় পর্যালোচনা” শীর্ষক এক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
ইউএইচসি ফোরামের কনভেনর এবং ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে এই সংলাপটির উদ্দেশ্য ছিল বন্যার কারণে সৃষ্ট বহুমাত্রিক স্বাস্থ্য সংকট নিয়ে আলোচনা করা এবং জরুরি প্রয়োজন মোকাবেলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপগুলো চিহ্নিত করা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।
অনুষ্ঠানে উপদ্রুত এলাকার সিভিল সার্জনরা জানান, এসব এলাকায় ডায়রিয়া এবং ত্বকের সংক্রমণের মতো পানিবাহিত রোগ তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়াও পানিতে ডুবে মৃত্যু, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া এবং সাপে কাটা রোগীর সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
অনুষ্ঠানে বন্যা কবলিত জেলার সিভিল সার্জন, সেনাবাহিনীর কুমিল্লা অঞ্চলের জিওসি, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থী, ফটিকছড়ি, খাগড়াছড়ি ও মাইজদীর বেসরকারি ও এনজিও প্রতিনিধিসহ ১৩০ জনেরও বেশি অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পেশাজীবীদের বিভিন্ন গ্রুপ, এনজিও, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বন্যার কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণে একটি সমন্বিত কৌশলগত কর্মপন্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং চলমান বন্যার কারণে জাতির জন্য এটি একটি কঠিন সময়। আমাদের সকলকে কার্যকরভাবে স্বাস্থ্যখাতের চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করার জন্য এক হতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে। বন্যা পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম থেকে কেউ যেন বাদ না পড়ে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাঃ মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, “এ ধরনের দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষিত পেশাদারদের সবার আগে মাঠে নামা দরকার। এ সময় পানিতে ডুবে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, সাপের কামড় অথবা অজ্ঞাত প্রাণীর কামড়ে মৃত্যুর কারণগুলো আমাদের অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে।”
ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচির (বিএইচপি) ঊর্ধ্বতন পরিচালক ড. মোঃ আকরামুল ইসলাম বলেন, “প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের চাহিদা পূরণ, বিশেষ করে অধিক সংখ্যক রোগির সেবাদান নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। এর পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা, সমন্বয় এবং তথ্য প্রাপ্তির বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী, সংক্রামক এবং অসংক্রামক রোগের ব্যবস্থাপনাকে উপেক্ষা করা যাবে না। সেইসাথে জীবাণুবাহিত সংক্রমনের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।”
সেনাবাহিনীর কুমিল্লা অঞ্চলের জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর হারুন বলেন, “বন্যার সময় গর্ভবতী নারী, শিশু এবং বয়স্কদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গর্ভবতী নারীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত রাখা এবং দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে কাজে ঝাপিয়ে পড়তে ‘রেডি-টু-ডেপ্লয়’ টিম প্রস্তুত রাখা জরুরি।” দুর্যোগ মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতির পাশাপাশি ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইউএইচসি ফোরামের প্রতিনিধি ডাঃ আমিনুল হাসান বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং এই সংকট মোকাবেলায় ১০টি অ্যাকশন পয়েন্ট প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, “স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক, এনজিও এবং সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ সত্ত্বেও ত্রাণবিতরণ, চিকিৎসা সেবা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিসেবার ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।”
এ সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়া মানুষদের উপর ডাকাতি হওয়ার ঘটনা দেখা গেছে, এ সমস্ত অপ্রীতিকর ঘটনা কিভাবে এড়ানো যায়? মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটছে তা থেকে পরিত্রান পাওয়া যাবে কিভাবে?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ এম এ ফয়েজ বলেন, “সমস্ত বন্যার জল দূষিত, তাই সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন করা জরুরি। নিরাপদ পানি সরবরাহ, যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোকে অতিস্বত্তর দূষণমুক্তকরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, “প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরে না, যার ফলে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন দেখা যায় না। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করে সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।”
এই সংলাপের আলোচিত বিষয়গুলো ভবিষ্যতের দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে অবকাঠামো, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলোর বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে ভবিষ্যতের দুর্যোগ মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে বলে আলোচকরা আশা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, তীব্র বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে আসা পানির প্রবাহের কারণে সৃষ্ট বাংলাদেশে সাম্প্রতিক আকস্মিক বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলার ৫৮ লাখেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
Leave a Reply