মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:০১ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের মানুষ বাঁচতে জানে 

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮.০০ এএম

স্বদেশ রায় 

১৯৮৪’র উড়ির চরের ঘূর্ণি ঝড় থেকে ১৯৯৬ এর চট্টগ্রামের ঘূর্নিঝড় অবধি বাংলাদেশে যতগুলো ঘূর্নিঝড় হয়েছে- সবগুলো ঘূর্নিঝড় আক্রান্ত এলাকার রিপোর্ট করেছি। আবার এই বড় বড় ঘুর্নিঝড় গুলো ছাড়াও ১৯৮৮তে সুন্দরবনের ওপর দিয়ে একটা ঘূর্নিঝড় বয়ে যায়। যা লোকালয়কে ক্ষতিগ্রস্থ করেনি। ক্ষতিগ্রস্থ করেছিলো সুন্দরবনকে। সেই ঘূর্নিঝড়েরও তিন দিন পরে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে কাঠুরিয়াদের সাহায্য নিয়ে সুন্দরবনের সেই ক্ষত দেখেছি। যতটা পারি লিখেছি। আর ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ এর বন্যায় কবলিত বির্স্তীন এলাকা ঘুরে রিপোর্ট করি। এছাড়া দেশের বাইরেও কয়েকটি বন্যা কবলিত এলাকার রিপোর্ট করারও সুযোগ হয়।

এই সব রিপোর্ট করতে গিয়ে সব থেকে বেশি অবাক হয়েছি বাংলাদেশের মানুষের প্রাণশক্তি ও তাদের অভিজ্ঞতা দেখে। এই গাঙ্গেয় বঙ্গের মানুষ যে হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে শিখেছে তা বাস্তবে মানুষের কাছে যাবার সুযোগ না হলে কখনই জানতে পারতাম না।

তেমনি বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসন ও সামরিক বাহিনী প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় অনেক ধণী দেশের থেকেও অনেক বেশি দক্ষ। আর আমাদের মত অর্থনীতির দেশগুলোর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসন ও সামরিক বাহিনী এই দুর্যোগ মোকাবিলার কাজে অনেক বেশি যোগ্য। যেমন বাংলাদেশের একটি বন্যায় যখন দেশের বড় অংশ ডুবে গিয়েছিলো সে সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদে বন্যা হয়। ওই বন্যার পানি তারা তিন মাসেও সঠিকভাবে নামাতে পারেনি। আর সরবরাহ ছিলো বাংলাদেশের থেকে অনেক নিম্মমানের।

এই ঘুর্ণিঝড় ও বন্যার রিপোর্ট করতে গিয়ে প্রথমে এ দেশের মানুষের প্রাণশক্তি সম্পর্কে ধারণা বদলে যায় ১৯৯১ এর ঘুর্ণিঝড়ের দুই দিন পরে কুতুবদিয়ায় পৌঁছে। ঘুর্ণিঝড়ের দুই দিন পরে কুতুবদিয়ার জেলে পাড়ায় যাই খুব ভোরে। তার আগের দিনের ক্লান্তিতে সঙ্গীরা প্রায় সকলেই তখন ঘুমিয়ে- তাই কাউকে ডিস্টার্ব না করে একাই চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ওই মাছ ধরে বেঁচে থাকা সম্প্রদায়ের মানুষের সকলেরই ঘর বাড়ি পানিতে ভেসে গেছে। তাদের মাছ ধরার নৌকা ও জাল সবই গেছে পানিতে। তারপরেও তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অবাক হই। তারা বলে, তাদের রিলিফ দরকার নয়, তাদের দরকার কিছু ঋণ। তারা কিছু ঋন পেলে আবার নৌকা ও জাল তৈরি করে ঠিকই সাগরের কৃপায় আগের মতই বেঁচে থাকতে পারবে।

ওই প্রথম দীর্ঘদিনের একটা ধারণা ভেঙ্গে যায়। বুঝতে পারি, এদেশের মানুষ নিজের থেকে বাঁচতে পারে। জেলে পাড়ার ওই বাস্তবতা শুধু রিপোর্টের জন্যে একটা নতুন আঙ্গিক দেয়নি, দেশের মানুষ সম্পর্কেও ধারনা বদলে যায়। কারণ, ১৯৮৮ এর বন্যার রিপোর্ট করেছিলাম ঢাকার চারপাশ জুড়ে। সেখানে কেবলই শহরের মানুষের ত্রান দেবার তাগিদ থাকতো। আর ওই গুলোকেই তখন অনেক বড় মনে করেছি। মানুষের প্রাণশক্তি সম্পর্কে সে সময়ে কোন ধারণা তৈরি হবার সুযোগও হয়নি। হয়তো বোধও ছিলো না।

ঠিক একই অভিজ্ঞতা হয়, ১৯৯৮ সালের বন্যার রিপোর্ট করতে গিয়ে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সাভার, ধামরাই, কালীগঞ্জ এসব জায়গা ঘুরে।

মানিকগঞ্জ ও কালীগঞ্জ এ গিয়ে এমনও পরিবার পেয়েছি তারা ঘরের মাঁচার ওপর বসে দুই দিন ধরে চিড়ে, মুড়ি, গুড় এসব খেয়ে আছে। মানিকগঞ্জে একটি বাড়িতে দেখতে পাই ওই মাঁচার ওপর বসেও তাদের ঘরের দশ বছরের একটি মেয়ে এবং ছয় সাত বছরের একটি ছেলে তাদের ক্লাসের পড়া পড়ছে। আর নৌকায় করে ব্রাক তাদের “এক শিক্ষক এক স্কুল”  এর  কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মানিকগঞ্জের এক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে আরো দুটো অভিজ্ঞতা হয়- এক, তিনি হিসাব করে দিন তারিখ বলে দেন- কবে থেকে পানি নামা শুরু করবে। দুই, বন্যার ওই পানির ক্ষত তিনি রবি শস্য ফলিয়ে কাটিয়ে উঠবেন বলে আশাবাদী।

৯১ এর এপ্রিলের ঘূর্নিঝড়ের এক বছর পরে কুতুবদিয়ার ওই জেলে পাড়ায় আবার গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখিতাদের প্রায় সকলের ততদিনে নৌকা ও জাল হয়ে গেছে। আবার তাদের ঘরে ঘরে শুটকি ও তাজা মাছ বিক্রির জন্যে প্যাক হচ্ছে। অবশ্য ত্রানের বাইরে তাদেরকে ঋন কম দেয়া হয়েছিলো। যে কারণে অন্যভাবে তাদেরকে টাকা জোগাড় করতে হয়েছিলো। বড় মাছ ব্যবসায়ীর টাকা তাদের বেশি সুদে নিতে হয়েছিলো।

আর বন্যা কবলিত ওই মানিকগঞ্জ, ধামরাই, মুন্সীগঞ্জ, কালীগঞ্জ যাই ওই বছরেরই শেষ হেমন্তে। সেখানে তখন সবজি ও শর্ষে গাছের বাহার এবং কৃষকের চোখের আনন্দ দেখে বোঝার কোন উপায় ছিলো না মাত্র কয়েক মাস আগে এখানে মানুষেরা পানিবন্দী ছিলেন।

ঘুর্ণিঝড় আক্রান্ত কুতুবদিয়ায় এবং বন্যাপ্লাবিত এই এলাকাগুলোতে দ্বিতীয়বার গিয়ে মানুষের মুখের ভাষা থেকে শিখতে পারি, আসলে বাংলাদেশের মানুষ নিজেই বাঁচতে জানে।

লেখক: সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World. 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024