শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০১ অপরাহ্ন

প্রকৃতিবিদের কাহিনী (কাহিনী-২৪)

  • Update Time : রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

পিওতর মান্তেইফেল

বরফ-ঢাকা সাগরে

অধিকাংশ সীলমাছ থাকে উত্তরে, ঠান্ডা সাগরে। অনেকক্ষণ ধরে তারা মাছ, বাগদা চিংড়ি, শামুক ইত্যাদি শিকার করার পর জল থেকে উঠে আসে তীরে কিংবা ভাসমান তুষার স্তরের ওপর। কিন্তু জল থেকে সীল উঠে আসে কী করে, যখন শীতকালে সমস্ত সাগর জুড়ে যায় তুষার স্তরে? একটা মত আছে যে এরা তাদের শরীরের তাপ দিয়ে বরফ গলিয়ে কেবল ওপর থেকেই তুষার স্তরে ফুটো করতে পারে। এটা অবশ্যই ঠিক নয়। সামুদ্রিক পশুদের দেহের উপরিস্তরে চর্বির মোটা আচ্ছাদনে ভেতরের তাপ ভালোভাবেই আটকে থাকে, তাই বরফের ওপর দীর্ঘকাল পড়ে থাকলেও তাতে সামান্য একটু তুহিন খালের মতো হয় মাত্র।

চিড়িয়াখানায় আমরা একটা পরীক্ষা চালাই, ফলে এ প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। শরৎকালে আমরা সাতটা গ্রীনল্যান্ডী সীলমাছকে ছাড়ি নতুন এলাকার একটা বড়ো পুকুরে। শীতে তুষারস্তরে পুকুর ঢেকে গেল, শুধু খাবার জায়গাটায় বরাবর ছিল খানিকটা বরফে না-ঢাকা খোলা জল। একবার ভয়ানক ভয় পেয়ে সীলমাছগুলো তাড়াতাড়ি জলের তলে গিয়ে লুকোয়। শিগগিরই খোলা জায়গাটাও বরফে ছেয়ে গেল, বন্ধ হয়ে গেল তাদের বাইরে বেরিয়ে আসার পথ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটল। অবস্থা বদলাল না। আশঙ্কা হল, জানোয়ারগুলো মারা পড়ল না তো?

সকালে একটা ভাপের ফোয়ারা চোখে পড়ল আমার, পুকুরের তুষারস্তরটার ওপরে উঠে সাবধানে এগিয়ে গেলাম জায়গাটার দিকে। স্বচ্ছ সবজেটে তুষার- স্তরের মধ্য দিয়ে বেশ দেখা গেল সাতটা সীলমাছের সবকটাই ছোট্ট একটা ফাটলে নাক গজে একসঙ্গে বাতাস টানছে। আর তারা যে নিঃশ্বাস ছাড়ছে, তাতে বুদবুদ উঠছে বরফের তলে, আর জলের দিকটা থেকে বরফ গলে যাচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা পরে জায়গাটায় খোলা জল দেখা গেল।

সন্দেহ নেই যে উত্তরেও সালমাছেরা ঠিক এই করে, কেননা বিভিন্নমুখী বাতাস, জোয়ার আর স্রোতের প্রভাবে মেরু, সাগরের বরফে সর্বদা ও সর্বত্রই দেখা দেয় ফাটল। পরে আমাদের পর্যবেক্ষণের সঠিকতা সমর্থন করেন মেরু-অভিযানী ও শিকারবিদরা, উত্তরের প্রাণিসম্পদ নিয়ে যাঁরা সন্ধান চালাচ্ছেন। সরু ফাটলে একদল সামুদ্রিক প্রাণীকে নাক গুজে থাকতে দেখলে শিকারীরা বলে:

‘সালমাছেরা ফং দিয়ে বরফ গলাচ্ছে’ শীতে চিড়িয়াখানার পুকুরটা ঢেকে যায় বরফের পুরু স্তরে। সাঁলমাছেরা তখন জল থেকে উঠে আসে কদাচিৎ, বাতাসের তাপমাত্রার চেয়ে বরফের তলেকার জলের তাপমাত্রা তখন অনেক গরম। বসন্তে তারা বেরিয়ে আসে রোদ পোয়াবার জন্যে, ঘুমোয় অনেকখন ধরে, তবে সজাগ ঘুম। বরফ যখন একেবারে গলে যায়, তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সালমাছেরা সাঁতরাতে পারে মোটর-লঞ্চের চেয়ে বেশি দ্রুত বেগে। জলাশয়টা তারা চষে বেড়ায় সব দিক থেকে কখনো জলের তলে, কখনো ওপরে, কখনো চিৎ সাঁতার দিয়ে, কখনো-বা কাত হয়ে। জলে একটা মাছ ছাড়া মাত্র চিড়িয়াখানায় উত্তর-মেরুবাসী এই পোষ্যেরা আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় তাকে তাড়া করে। স্কুলে যারা অমন গুরুভার, বেঢপ, তাদের কাছে সেটা আশা করা কঠিন।

শিকার করে আর সাঁতরে ক্লান্ত হয়ে সীলমাছ প্রায়ই পুকুরের তলে ঘুমিয়ে পড়ে। মিনিট তিন-চার নিথর হয়ে পড়ে থাকে সে, তারপর ওপরে উঠে আসে আধা-ঘুমন্ত অবস্থায়। এখানে সে তার বিপুল ফুসফুস ভরে নিঃশ্বাস নেয়, মুহূর্তের জন্যে চোখ মেলে তারপর ফের তলিয়ে যায় নিচে।

সালমাছের ঘুম সর্বদাই ছটফটে। তুষারম্ভরের ওপরে থাকলে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর চোখ মেলে তারা। ঘুম ভেঙেই সীলমাছ দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় চারিদিকে, যেন যাচাই করে নিতে চায়, কোথাও কোনো বিপদ নেই তো? শ্বেত ভল্লুক নেই তো কাছাকাছি? তারপরেই সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। মনে হবে বুঝি, নিরাপত্তার এ ব্যবস্থাটা ওরা ভেবে বার করেছে। কিন্তু সামুদ্রিক জীবেরা এটা করে তাদের স্বজ্ঞায়, জন্মগত (অনপেক্ষ) প্রতিবর্ত’ ক্রিয়ায়, উত্তর মেরুর স্বকীয় জীবন- পরিস্থিতিতে তা গড়ে উঠেছে তাদের পূর্বপুরুষদের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায়।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024