মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫৮ পূর্বাহ্ন

প্রাচুর্যবান হওয়ার সূত্র

  • Update Time : শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮.০০ এএম

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

ধনী হতে চায় অনেকেই। সব সমাজেই ধনবান ব্যক্তি গুরুত্ব পান। তাই মানুষের আগ্রহ থাকে কীভাবে ধনী হওয়া যায়। এ জন্য তারা নানা উপায়ে জানতে চেষ্টা করতে কীভাবে ধনী হওয়া যায়। কেউ হয়তো ধনীদের জীবনী পড়েন। কেউ তাদের কৌশল শেখার চেষ্টা করেন। কেউ বা ধনী হওয়ার টিপস আছে এমন বইয়ের সহায়তা নেন। বিদেশি বই থেকে ফুটপাথে বিক্রি হওয়া নানা ধরনের বই পাওয়া যায়। ‘ধনী হওয়ার সিক্রেট কৌশল’, ‘ধনী হওয়ার ৫৫ অব্যর্থ মন্ত্র’ ইত্যাদি।

কীভাবে ধনী হওয়া যায়, এটা শুধু সাধারণ মানুষের ভাবনার বিষয় থাকে নি। পৃথিবী জুড়ে অনেক গবেষক পণ্ডিত বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ড. জো ভাইটাল তেমনই একজন। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। তার লেখা বেশ কিছু বই বেস্ট সেলারের তালিকায় এসেছে। এর মধ্যে ‘স্পিরিচুয়াল মার্কেটিং’ অন্যতম। ড. জো একবার উদ্যোগ নিলেন মানুষ কেন ধনী হয় বিষয়টি জানতে। তিনি বিশ্বের নামকরা বেশ কয়েকজন শীর্ষ ধনীর জীবন বিশ্লেষণ করে লক্ষ করলেন তারা অনেক মন্ত্র নয়, মূলত একটি সূত্র মেনে চলেই ধনী হয়েছেন। বিষয়টি তাকে এতো বেশি প্রভাবিত করে যে তিনি দি গ্রেটেস্ট মানি মেকিং সিক্রেট ইন হিস্ট্রি’ নামে একটি বই লিখে ফেলেন। শুধু বই লেখা নয়, এক পর্যায়ে নিজের জীবনে সেই সূত্রের প্রয়োগ করে তিনি আশাতীত সফলতা লাভ করেন। ড. জো তার কেসহিস্ট্রিতে জন ডি রকফেলার, অ্যান্ড্রু কর্নেগিসহ আরো কয়েকজনের জীবন নিয়ে এসেছেন। তিনি দেখিয়েছেন এই সব সফল মানুষেরা একটি বিষয় নিয়মিত করতেন। তারই প্রতিফল হিসাবে তারা ধনী হয়েছেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য, সেই কাজটি হলো দান। ড. জো যাকে বর্ণনা করেছেন, ‘দি পাওয়ার অফ গিভিং’ হিসেবে।

জন ডি রকফেলার ছিলেন পৃথিবীর প্রথম ঘোষিত বিলিওনেয়ার। ১৯১৬ সালে এই ঘোষণা আসে। রকফেলার ১৯২৪ সালে তার ছেলেকে লেখা এক চিঠিতে বর্ণনা করেন তার ধনী হওয়ার পেছনে নিঃশর্ত দান কতোটা প্রভাব ফেলেছে।

তিনি ছেলেকে দান করার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে লিখেছেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি দান করা শুরু করেন। কম হোক বেশি হোক সাধ্য অনুসারে তিনি

নিয়মিত দান করে গিয়েছেন। যখন আয় কম ছিল তখন দানের পরিমাণ কম ছিল, যখন আয় বেড়েছে দানের পরিমাণও বেড়েছে। রকফেলার তার সময়ে ৫৫০ মিলিয়ন ডলার দান করে গিয়েছেন। আরেক দানবীর ও সফল ব্যবসায়ী অ্যান্ড্রু কর্নেগি সরাসরি বলেছেন, ‘একজন মানুষের জীবন তার বয়স দিয়ে নয়, তিনি কতোটুকু দান করলেন সেটা দিয়ে পরিমাপ করা উচিত।’ গবেষক জো ভাইটাল ভাবলেন আদৌ দান করলে কোনো ফল আসে কিনা। তিনি একটি ছোট পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন কাকে দান করা যায়। অনেক ভেবে তিনি মাইক নামের এক প্রতিবেশীর কথা ভাবলেন। যিনি প্রতিদিন সকালে কিছু ভালো কথা লিখে প্রতিবেশীদের ইমেইল করেন। যাতে সবার সকালটা মধুর মনে হয়। অনেক চিন্তা করে ড. জো দেখলেন একবার নেহায়েত সামনে পড়ে যাওয়ায় মাইককে পাঁচ ডলার দিয়েছিলেন। অর্থের প্রয়োজন থাকলেও মাইক তা নিজে থেকে চান নি। ড. জো একদিন সকালে মাইকের বাড়িতে গিয়ে কলবেল চাপলেন। বিস্মিত মাইকের হাতে একটি খাম ধরিয়ে তিনি বের হয়ে এলেন। যে খামে এক হাজার ডলার ছিল।

দান করতে পারার এই আনন্দ ড. জোকে পেয়ে বসলো। তিনি তার প্রতিদিনের কাজে এক ধরনের গতি পেলেন। তবে তার ফল পেতে আরো বাকি ছিল। তিনি মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে একটি বইয়ের সহ-লেখক হওয়ার অফার পেলেন। তাকে যে পরিমাণ অর্থ দেয়ার কথা বলা হলো, সেটি দানের অর্থের কয়েকগুণ বেশি। আর কিছুদিন পর জাপান থেকে তিনি ফোন পেলেন। তাকে বলা হলো স্পিরিচুয়াল মার্কেটিং বইটি জাপানি ভাষায় অনূদিত হবে। তার জন্য তাকে যে পরিমাণ রয়‍্যালিটি দেয়া হবে তা তিনি ভাবতেও পারেন নি! এভাবে একের পর এক পরীক্ষার মাধ্যমে জো ভাইটাল যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তা হলো, আমরা যা দান করি তাই আমাদের কাছে ফিরে আসে। ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা ফিরে আসে। ঘৃণা দিলে ঘৃণা। বস্তু দিলে বস্তু। অর্থ দিলে অর্থ। এবং সেটা অনেক বেশি ফিরে আসে।

দানের বিষয়ে প্রায় প্রতিটি ধর্মই গুরুত্ব দিয়েছে।

কোরআনে আছে, তোমরা যা ভালোবাসো, তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনোই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না।

হাদিসে আছে, দান এতো নিরবে করা উচিত যেন ডান হাতে দান করলে বাম হাত জানতে না পারে।

ঋগবেদে আছে, নিঃশর্ত দানের জন্যে রয়েছে চমৎকার পুরস্কার। তারা লাভ করে আশীর্বাদধন্য দীর্ঘ জীবন ও অমরত্ব।

বুদ্ধবাণীতে বলা হয়েছে, কেউ যখন কাউকে দান করতে বাধা দেয় তখন সে তিনটি অন্যায় করে। প্রথমত, সে দাতাকে একটি ভালো কাজ থেকে বিরত করে। দ্বিতীয়ত, সে গ্রহীতাকে সাহায্য থেকে বঞ্চিত করে। তৃতীয়ত, নীচতার প্রকাশ ঘটিয়ে সে নিজের সত্তাকেই অপমানিত করে।

খ্রীষ্টধর্মে আছে, প্রতিটি ব্যক্তি আপন হৃদয়ে যেমন সংকল্প করে, সে রূপ দান করুক। মনোকষ্ট নিয়ে বা বাধ্য হয়ে নয়, কেননা ঈশ্বর হৃষ্টচিত্তের দাতাকে ভালোবাসেন।

ইহুদি শিশুকে ছোটবেলাতেই তার মোট আয়ের শতকরা দশভাগ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এবং আরো দশভাগ স্বার্থহীন জায়গায় দান করতে শিক্ষা দেয়া হয়। একজন দাতা শুধু তার সময়েই বরণীয় হন না, তিনি বেঁচে থাকেন যুগের পর যুগ। হাতেম তাই বা হাজি মহসীনের সময়ে আরো অনেক ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তাদের কেউ মনে রাখে নি।

অনেকেই ভাবতে পারেন, বর্তমানের প্রতিযোগিতার যুগে আর দান খয়রাত করার সুযোগ নাই। এগুলো আগেকার দিনে চলতো, এখন একবারেই অচল। এদের জন্য ছোট দুটি প্রশ্ন।

এক. বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির নাম কী?

উত্তর দিতে হয়তো সময় লাগবে না, বিল গেটস।

প্রশ্ন দুই, বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দান করেন কে?

উত্তর খুঁজতে গেলে যে নামটি পাওয়া যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং স্বচ্ছতাপূর্ণ দাতা সংগঠন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। যার প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এবং তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস। তাদের দান করা অর্থ বাংলাদেশেও নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি দেশের গণগ্রন্থাগারগুলো ডিজিটালাইজড করার যে প্রকল্প নেয়া হয়েছে তার পুরো অনুদান আসছে গেটস ফাউন্ডেশন থেকে। পৃথিবীর নানা দেশে এই ফাউন্ডেশন মানব সেবায় কাজ করে চলেছে। ২০১৩ সালে বিল গেটস এই ফান্ডে দান করেন ২৮ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে এই প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে আছে অন্তত ৪৪.৩ বিলিয়ন ডলার।

বিল গেটসের একটি উক্তি খুব বিখ্যাত। তিনি বলেছিলেন, গরিব হয়ে জন্ম নেয়া দোষের কিছু নয়, কিন্তু গরিব হয়ে মারা যাওয়াটা অপরাধ। বিল গেটস এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষের জন্ম যেখানেই হোক না কেন, চেষ্টা দিয়ে ভাগ্য বদল করা সম্ভব।

এক সময় অবশ্য বিল গেটস দানের বিষয়ে এতোটা সিরিয়াস ছিলেন না। তিনি সবসময়ই অর্থ উপার্জন নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তাকে নিয়ে অনেক গল্প তখন চালু ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল এমন, বিল গেটস কাজের সময় দাঁড়ানো অবস্থায় যদি তার হাত থেকে একশ ডলারের একটি বান্ডেল হাত থেকে পড়ে যায়, তবে তা তোলার চেয়ে তিনি দাঁড়িয়ে থাকলে আরো বেশি আয় করতে পারেন!

বিল গেটসের এই বদলে যাওয়ার পেছনে প্রভাব বিস্তার করেছেন আরেকজন মানুষ। যিনি খুব সাদাসিধা জীবন কাটান। ১৯৫৮ সালে একত্রিশ হাজার পাঁচশত ডলার দিয়ে তিনি একটি বাড়ি কিনেছিলেন। যেটা কিনা ১৯২১ সালে বানানো। এই বাড়িতে কোনো সীমানা প্রাচীর বা বেড়া নেই। তিনি তার পরিবার নিয়ে এখানেই বসবাস করেন। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে অফিসে যান। একজন সাধারণ মধ্যবিত্তের জীবন কথা হিসাবে এই বর্ণনা চলে যায়। কিন্তু যদি জানা যায়, লোকটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় জেট বিমান কোম্পানির মালিক এবং পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ধনী। যার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার! তবে? এই মানুষটির নাম ওয়ারেন বাফেট। যাকে ব্যবসায়ী দার্শনিক বলা হয়।

তার ছেলেমেয়ের মধ্যে পিটার বাফেট একজন মিউজিশিয়ান। পিটার তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছেলেবেলা থেকে তিনি জেনে এসেছেনে তার বাবা ওয়ারেন বাফেট একজন শীর্ষ ধনী। কিন্তু অন্যান্য ধনীর ছেলেমেয়েদের মতো খরচ করার মতো অর্থ বাবা কোনো দিনই দিতেন ন। যতোটুকু প্রয়োজন ঠিক ততোটুকুই দিতেন। এজন্য তার বন্ধুরা তাকে টিজ করতো। বাবার প্রতি অভিমানও হতো কখনো কখনো। কিন্তু পরে পিটার বুঝেছেন বাবা তাদের যে শিক্ষা দিয়েছেন সেটাই প্রকৃত শিক্ষা। জীবন থেকে শেখাটাই হচ্ছে আসল। এই পিটার একবার খুব অবাক হলেন যখন বাবা তাদের ভাইবোনদের ডেকে প্রত্যেককে প্রায় ১৪০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ শেয়ার দিলেন। ওয়ারেন বাফেট বললেন, এই অর্থ তোমরা ব্যবহার করো। তবে শর্ত হলো, নিজের জন্য নয়। মানব কল্যাণে এই অর্থ ব্যয় করতে হবে।

বাবার পরামর্শক্রমে পিটার নোভো ফাউন্ডেশন গঠন করে মানব কল্যাণে কাজ করছেন। একই ধরনের কাজ তার বোনও করছেন।

PIX 02

এই ওয়ারেন বাফেট একদিন অতি ব্যস্ত বিল গেটসের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলেন। আইটি ব্যবসায়ী বিল গেটস প্রথমে বুঝতে পারেন নি শেয়ার ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেট কেন তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। তিনি খুব অল্প সময়ের জন্য একটি রেস্টুরেন্টে বাফেটের সঙ্গে বসলেন। ওয়ারেন বাফেট কথা বলা শুরু করলেন। বিল গেটস শ্রোতা। মিটিং চলতে লাগলো। বিল গেটস তার সেক্রেটারিকে পরবর্তী অ্যাপয়েন্টগুলো বাদ দিতে বলতে লাগলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর তারা দু’জন বেরিয়ে এলেন। এক পর্যায়ে বিল গেটস ঘোষণা দিলেন, তার জীবনের অর্ধেক আয় তিনি মানবতার কল্যাণে ব্যয় করবেন। এজন্য তিনি এবং তার স্ত্রী মেলিন্ডা একটি ফাউন্ডেশন গঠন করবেন। ওয়ারেন বাফেট প্রথম ব্যক্তি হিসাবে এই ফাউন্ডেশনে দুই বিলিয়ন ডলার দান করার ঘোষনা দিলেন। শুরু হলো বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের পথচলা।

ওয়ারেন বাফেট এবং বিল গেটসের এটা শেষ নয়, বরং শুরু। তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে যৌথভাবে তারা বিশ্বের সেরা

ধনীদের ডিনারে আমন্ত্রণ জানান। সবার কাছে দানের গুরুত্ব তুলে ধরেন এই দুই শীর্ষ ধনী। ২০১০ সাল থেকে শুরু হলো বাফেট গেটসের ‘দি গিভিং প্লেজ’ ক্যাম্পেইন। বিস্ময়কর সাড়া পেলেন তারা। ২০১২ সালে ৮১জন বিলিওনেয়ার একত্রিত হয়ে তাদের আয়ের অর্ধেক চ্যারিটিতে দান করার ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালে আরো ১২২জন বিলিয়নেয়ার এই ক্যাম্পেইনে যোগ দেন। আগস্ট ২০১০ পর্যন্ত ঘোষিত দানের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৫ বিলিয়ন ডলার। এই ক্যাম্পেইনে যোগ দেয়া দাতার তালিকায় যেসব ধনীরা আছেন তাদের মধ্যে মাইকেল ব্লুমবার্গ, স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন, স্টিভ কেজ, জর্জ লুকাস, টেড টার্নার, মার্ক জাকারবার্গ অন্যতম।

এরা সবাই পাশ্চাত্যের। প্রাচ্যের কী অবস্থা? যে প্রাচ্যই এক সময় দানের শিক্ষা দিতো। এখানেও কিন্তু দানের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক দেখা যায়। এশিয়ার উন্নত দেশ জাপানের দিকে তাকালে দেখা যায় সুনামির পর সেখানকার তরুণদের মধ্যে দানের প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। উপমহাদেশের কারো কারো নাম শীর্ষ ধনীর তালিকায় থাকলেও দাতার তালিকায় তাদের অবস্থান ততো গুরুত্বপূর্ণ নয়। উপমহাদেশের একমাত্র ব্যক্তি হিসাবে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি দান করেছেন ভারতের উইপ্রোর মালিক আজিম প্রেমজি।

একথা কি তবে বলা যায়, উপমহাদেশে দানের প্রবণতা কমে গিয়েছে বলেই এখানে দারিদ্র্য এসে হানা দিয়েছো দাতার জাত পরিণত হয়েছে ভিক্ষুকে।

PIX 03

এ বিষয়ে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কৃপণ’ কবিতায়।

কবিতার কথক একজন ভিক্ষুক। তিনি যখন গ্রামের ভিক্ষা করছিলেন তখন হঠাৎ একটি স্বর্ণরথ দেখতে পেলেন। যেখানে অসাধারণ সাজসজ্জায় একজন

মহারাজ বসে ছিলেন। তাকে দেখে ভিক্ষুকের মনে হলো, আজ তার দিনটি খুব ভালো যাবে। তার অনুভূতি কবির ভাষায়,

আজি শুভক্ষণে রাত পোহালো তবে,

ভেবেছিলেম আজ আমারে দ্বারে দ্বারে ফিরতে নাহি হবে।

বাহির হতে নাহি হতে কাহার দেখা পেলেম পথে,

চলিতে রথ ধনধান্য ছড়াবে দুই ধারে- মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব,

নেব ভারে ভারে।

স্বপ্ন নিয়ে সেই ভিক্ষুক এগিয়ে চললেন রথের দিকে। হঠাৎ তার সামনে রথটি থেমে গেল। শুধু তাই নয় রথে বসা সেই রাজপুরুষ রথ থেকে নেমে ভিক্ষুকের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভিক্ষুকের মনে হলো এই সেই মুহূর্ত। এখনই সে কিছু পেতে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে বিস্মিত করে দিয়ে সেই রাজপুরুষ তার দিকে হাত

বাড়িয়ে দিলেন।

দেখে মুখের প্রসন্নতা

জুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা, হেনকালে কিসের লাগি তুমি অকস্মাৎ

‘আমায় কিছু দাও গো’ বলে বাড়িয়ে দিলে হাত।

এই কথা শুনে বিহবল হয়ে থাকা ভিক্ষুক মনে করলেন এই রাজপুরুষ বুঝি তার সঙ্গে রসিকতা করছেন। দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে তিনি তার থলের সবচেয়ে ছোট কণাটা তুলে দিলেন রাজপুরুষের হাতে। ভাঙ্গা হৃদয়ে বাড়ি ফিরে এলেন তিনি। ভিক্ষার পাত্রটিকে কী কী আজ জমা হয়েছে তা দেখতে গিয়ে তার মাঝে একটি ছোট সোনার কণা দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই বেদনাহত ভিক্ষুক বুঝতে পারেন তিনি কী ভুল করেছেন। কেন তিনি সব কিছু সেই রাজপুরুষের হাতে তুলে দিলেন না।

দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে, তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভবে- তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে।

এক সময় আমাদের সবাইকেই চলে যেতে হবে। সব কিছু আকড়ে ধরে থেকে জীবনের শেষ হিসাবে বসে আমাদের যেন বলতে না হয়: তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে।

 

ঢাকা, ২১ আগস্ট ২০১৬ রবিবার

লেখক: সাংবাদিক ও গণমাধ্যম উদ্যোক্তা, সম্পাদক-রুটস

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024