সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১২ পূর্বাহ্ন

ইতালির যে শহরে ‘বাংলাদেশি অভিবাসনের কারণে’ ক্রিকেট খেলা নিষিদ্ধ

  • Update Time : শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮.২১ পিএম
মনফ্যালকোন শহরে ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করলে ১০০ ইউরো জরিমানা দিতে হতে পারে।

সোফিয়া বেটিজা, মনফ্যালকোন

ইতালির অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্র উপকূলে প্রখর রোদের মধ্যে বাংলাদেশের একদল বন্ধু কংক্রিটের ছোট্ট একটি অংশে তাদের ক্রিকেট দক্ষতা অনুশীলন করছে।

তারা মনফ্যালকোন শহরের অদূরে ট্রিয়েস্ট বিমানবন্দরের কাছে খেলছে, কেননা শহরের ভেতরে এই ক্রিকেট খেলা নিষিদ্ধ করেছে সেখানকার মেয়র।

কেউ এখানে ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করলে তাদেরকে ১০০ ইউরো পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে।

দলের অধিনায়ক মিয়া বাপ্পি বলেছেন, “আমরা যদি মনফ্যালকোনের ভিতরে খেলতাম, তাহলে পুলিশ আমাদের থামাতে এরমধ্যেই চলে আসত”।

তিনি জানান, বাঙালি অভিবাসীদের মধ্য খুব জনপ্রিয় এই খেলাটি বেশ কয়েকজন কিশোর স্থানীয় পার্কে খেলতে গিয়ে “ধরা” পড়েছিল।

তারা জানতো না যে তাদের এই খেলার দৃশ্য নিরাপত্তা ক্যামেরায় ধারণ করা হচ্ছে।

পরে পুলিশের টহল দল তাদের এই খেলা ভেঙে দেয় এবং এজন্য তাদের জরিমানাও করা হয়।

“তারা বলে ক্রিকেট ইতালির জন্য নয়। তবে যদি সত্যি বলি, এর কারণ আমরা বিদেশি।”

ক্রিকেটের উপর শহরটির এই নিষেধাজ্ঞা মূলত মনফ্যালকোনে অন্তর্নিহিত উত্তেজনার এক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে।

এই শহরটির জাতিগত বৈশিষ্ট্য ইতালির অন্যান্য এলাকা থেকে বেশ আলাদা।

মাত্র ৩০ হাজার জনসংখ্যার এই শহরের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বিদেশি; তাদের আবার বেশিরভাগই বাংলাদেশি মুসলমান, যারা ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে বিশালাকার ক্রুজ-শিপ তৈরির কাজ করতে ইতালি আসতে শুরু করে।

ডানপন্থী মেয়র আনা মারিয়া সিসিন্ট।

আর এই জাতিগত বৈশিষ্ট্যের বিষয়টিকেই মনফ্যালকোনের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের ওপর হুমকি হিসেবে দেখেন এই শহরের ডানপন্থী মেয়র আনা মারিয়া সিসিন্ট।

অভিবাসনবিরোধী মনোভাবের ওপর ভর করেই তিনি ক্ষমতায় এসেছেন – এবং তার লক্ষ্য এই শহরকে “সুরক্ষা দেয়া” এবং খ্রিস্টান মূল্যবোধ রক্ষা করা।

“আমাদের ইতিহাস মুছে ফেলা হচ্ছে,” তিনি আমাকে বলেন “এমন হয়েছে যে এটা কোন ব্যাপারই না। সবকিছু খারাপের দিকে যাচ্ছে।”

মনফ্যালকোনে, পশ্চিমা পোশাকের ইতালীয়রা সালওয়ার কামিজ এবং হিজাব পরা বাংলাদেশিদের সাথে মিশছে।

এখানে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ এবং হালাল দোকান রয়েছে এবং সাইকেল পাথের একটি নেটওয়ার্ক আছে যা বেশিরভাগ দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায় ব্যবহার করে।

মিসেস সিসিন্ট তার দুই মেয়াদে টাউন স্কয়ারের বেঞ্চগুলি সরিয়ে দেন যেখানে বাংলাদেশিরা বসত, সেইসাথে মুসলিম নারীরা সমুদ্র সৈকতে যা পরেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।

“এখানে ইসলামিক মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার বেশ শক্তিশালী একটি প্রক্রিয়া চলছে। যে সংস্কৃতিতে নারীরা পুরুষদের দ্বারা দুর্ব্যবহার এবং নিপীড়িনের শিকার হয়।”

মেয়র মুসলমানদের প্রতি তার এমন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত পেয়েছেন – যেকারণে তাকে এখন ২৪-ঘণ্টা পুলিশ সুরক্ষার মধ্যে থাকতে হয়।

ইউরোপের সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের অন্যতম বড় শিপইয়ার্ড ফিনক্যান্টিয়েরি

মিয়া বাপ্পি এবং তার সাথের ক্রিকেটাররা ইতালিতে এসেছিলেন ইউরোপের সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের অন্যতম বড় শিপইয়ার্ড ফিনক্যান্টিয়েরিতে জাহাজ তৈরির কাজ করতে

মেয়র এই কোম্পানিকে কম বেতনের মজুরি ভাণ্ডার বলে অভিযুক্ত করেছেন, এর পেছনে তার যুক্তি হল: কোম্পানিটি এখানে কাজ করার জন্য এত কম বেতন দেয় যে কোনও ইতালীয় একই অর্থের বিনিময়ে কাজ করতে চাইবে না।

তবে শিপইয়ার্ডের পরিচালক ক্রিশ্চিয়ানো বাজ্জারা দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে কোম্পানি এবং এর ঠিকাদাররা শ্রমিকদের যে বেতন দেয় তা ইতালীয় আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

“আমরা প্রশিক্ষিত শ্রমিক খুঁজে পাচ্ছি না। ইউরোপে শিপইয়ার্ডে কাজ করতে চায় এমন তরুণদের খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন,” তিনি জানান।

বিশ্বের যেসব দেশে জন্মহার সবচেয়ে কম, ইতালি তাদের মধ্যে একটি। গত বছর শুধুমাত্র ইতালিতে তিন লাখ ৭৯ হাজার শিশুর জন্ম হয়। গড়ে হিসাব করলে একজন নারী এক দশমিক দুটি শিশু জন্ম দিয়েছে।

এতে করে শ্রমের ঘাটতিরও মুখোমুখি হচ্ছে দেশটি এবং গবেষকদের ধারণা ইতালির এই ক্রমহ্রাসমান কর্মশক্তি পূরণের জন্য ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে দুই লাখ ৮০ হাজার বিদেশী শ্রমিকের প্রয়োজন হবে।

ইতালির প্রধানমন্ত্রী এবং কট্টর-ডানপন্থী ব্রাদার্স অব ইতালির নেতা জর্জিয়া মেলোনি অভিবাসন কমাতে চান এমন কথা বলা সত্ত্বেও সম্প্রতি নন-ইইউ কর্মীদের জন্য পারমিট বা অনুমোদনের সংখ্যা বাড়িয়েছেন।

কিন্তু আনা মারিয়া সিসিন্ট কঠোরভাবে বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশি মুসলমান সম্প্রদায়ের জীবনধারা স্থানীয় বংশোদ্ভূত ইতালীয়দের জীবনের সাথে ‘বেমানান’।

মনফ্যালকোন শহরের দুটি ইসলামিক কেন্দ্রে সম্মিলিত প্রার্থনা হয়।

মনফ্যালকোনে উত্তেজনা চরমে ওঠে যখন মেয়র শহরের দুটি ইসলামিক কেন্দ্রে সম্মিলিত প্রার্থনা নিষিদ্ধ করেন।

মেয়র বলেন, “শহরের বাসিন্দারা আমাকে চমকে দেওয়ার মতো ছবি এবং ভিডিও পাঠাতে শুরু করে। যেখানে দেখা যায় দুটি ইসলামিক কেন্দ্রে বিপুল সংখ্যক লোক প্রার্থনা করছে: একটি ভবনের ভেতরে প্রায় ১৯০০ জন!”।

“ফুটপাথের ওপর অনেক মোটরসাইকেল পড়ে থাকে, এবং দিনে পাঁচবার উচ্চস্বরে আজান দেয়া হয় – এমনকি রাতেও।”

মেয়র সিসিন্ট বলেছেন যে, এমন আচরণ স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য অন্যায্য। এবং তিনি যুক্তি দেন যে তার এই নিষেধাজ্ঞার নগর পরিকল্পনা বিধিমালা অনুযায়ী দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, নগর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসলামিক কেন্দ্রগুলো ধর্মীয় উপাসনার জন্য তৈরি করা হয়নি এবং তিনি এও বলেন এধরনের বন্দোবস্ত করে দেয়া তার কাজ নয়।

ইতালীয় আইনের অধীনে আনুষ্ঠানিক মর্যাদা রয়েছে এমন ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলাম নেই, যার কারণে দেশটিতে ইসলামিক উপাসনালয় নির্মাণ প্রক্রিয়া বেশ জটিল।

ইতালিতে প্রায় ২০ লাখ মুসলমান বসবাস করলেও সারা দেশে মাত্র আটটি মসজিদ রয়েছে। সেই তুলনায় ফ্রান্সে মসজিদ রয়েছে দুই হাজারের বেশি।

মনফ্যালকোনের বাংলাদেশিরা

মনফ্যালকোনের বাংলাদেশিরা বলছেন, মেয়রের সিদ্ধান্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

১৯ বছর বয়সী মেহেলি বলেছেন, “মেয়র মনে করেন যে বাঙালিরা ইতালিকে ইসলামিকরণ করার চেষ্টা করছে – কিন্তু আমরা কেবল আমাদের নিজেদের নিয়েই আছি” তিনি মূলত ঢাকার বাসিন্দা, তবে ইতালিতে বড় হয়েছেন, পশ্চিমা পোশাক পরেন এবং সাবলীল ইতালীয় ভাষায় কথা বলেন।

তিনি বলেন, শুধুমাত্র তার বাঙালি ঐতিহ্যের কারণে তাকে রাস্তায় হেনস্থা করা হয়েছে।

“আমি যত তাড়াতাড়ি পারি এই শহর ছেড়ে চলে যাব।”

মিয়া বাপ্পি এই বছর তার ইতালীয় পাসপোর্ট পাবেন বলে আশা করছেন, কিন্তু তিনি নিশ্চিত নন যে তিনি মনফ্যালকোনে আর বসবাস করবেন কিনা।

“আমরা কোনো ঝামেলা করি না। আমরা ট্যাক্স দেই, কিন্তু তারা আমাদের এখানে চায় না।” বলেছেন শিপইয়ার্ডের এই কর্মী।

মনফ্যালকোনের বাংলাদেশিরা

মিয়া বাপ্পি আরো বলেন তারা সবাই যদি আগামীকাল তাদের স্বদেশে ফিরে যান, তাহলে শিপইয়ার্ডের একটি জাহাজ তৈরি করতে পাঁচ বছর সময় লাগবে”।

গ্রীষ্মে একটি আঞ্চলিক আদালত দুটি ইসলামিক কেন্দ্রের পক্ষে রায় দেয় এবং সম্মিলিত প্রার্থনা নিষিদ্ধ করার বিষয়ে টাউন কাউন্সিলের আদেশ বাতিল করে।

তবে মনফ্যালকোনের মেয়র ইতালির বাইরেও “ইউরোপের ইসলামিকরণ”-এর বিরুদ্ধে তার প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তিনি বর্তমানে ইউরোপীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন এবং শিগগিরই তিনি ব্রাসেলসেও তার এই বার্তা নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।

বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024