সারাক্ষণ ডেস্ক
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, আমি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রদের বলেছিলাম… তোমরা শহীদ মিনারে গিয়ে শপথ নাও। শহীদ মিনার হচ্ছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রতিক। স্বাধীনতা যুদ্ধে লক্ষ্য ছিলো বৈষম্যমুক্ত নিজেদের একটি দেশ। জাতীয় স্মৃতিসৌধ হচ্ছে বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের চেতনার প্রতিক। আওয়ামী লীগ দেশে বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলো, তাদের শোষণ ও নির্যাতনের জন্যই তাদের পতন হয়েছে। কোন রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের পতন হয়নি। সরকারের পতন হয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার অন্দোলনের মুখে। আমরা সব সময় বৈষম্য ও দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। সাধারণ মানুষের ধারণা ছিলো, ছাত্ররা রাজনীতিতে আসতে চায়না। কেউই বুঝতে পারেনি, ছাত্ররা এতটাই রাজনীতি সচেতন। প্রমাণ করেছে, ছাত্ররা আমাদের চেয়ে বেশি রাজনীতি বোঝে। ছাত্রদের প্রধান শক্তি হচ্ছে একতা আর দ্বিতীয় শক্তি হচ্ছে জনগনের আস্থা। ছাত্রদের প্রতি জনগনের আস্থা ছিলো, তারা দেশের জন্যই আন্দোলন করেছে। সেজন্যই ছাত্রদের ঐক্য ধরে রাখতে হবে এবং ক্ষমতা ও লোভ লালসার বাইরে থাকতে হবে।
আজ দুপুরে জাতীয় ছাত্র সমাজ কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে মতবিনিময় সভায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এ কথা বলেন।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের আরো বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমরা শুরু থেকেই ছাত্রদের ন্যায্য দাবির পক্ষে ছিলাম। কোটা পদ্ধতির বিপক্ষে আমরা সংসদে কথা বলেছি। সংসদের বাইরেও বক্তৃতা ও বিবৃতিতে আমরা বলেছি, চাকরিতে কোটা পদ্ধতি হচ্ছে সংবিধান পরিপন্থি। আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, টাকা পাচার, বৈষম্যের মাধ্যমে জাতিকে বিভাজন করার বিরোধীতা করে আমরা সব সময় কথা বলেছি। সংসদে আমি শেখ হাসিনার সামনেও আওয়ামী লীগের দুর্ণীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। যখন মানুষের নিরাপত্তা ছিলোনা… জীবনের নিশ্চয়তা ছিলোনা, তখনও আমরা সরকারের সমালোচনা করতে পিছপা হইনি। আওয়ামী লীগ আমাদের দলকে নষ্ট করতে চেয়েছে, একইসাথে আমাদের রাজনীতি করতেও বাঁধা দিয়েছে। দল না থাকলে রাজনীতি থাকেনা, আবার রাজনীতি না থাকলে দলও থাকেনা। জনগনের পক্ষে রাজনীতি না থাকলেও দল থাকেনা। আমাদের রাজনীতির জন্য দলকে স্যাকরিফাইজ করতে হয়েছে। আবার, দলের জন্যও রাজনীতি স্যাকরিফাইজ করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আমাদের দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, সেই ষড়যন্ত্র এখনও চলছে।
প্রধান অতিথির ব্কৃতায় গোলাম মোহাম্মদ কাদের আরো বলেন, জাতীয় পার্টি সব সময় জনগণের সাথেই ছিলো। তাই, ৩৪ বছর পরেও জাতীয় পার্টি রাজনীতির মাঠে টিকে আছে। জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়ে কেইউ কিছু চিন্তা করে না। আমরা এখনই নির্বাচন চাই না। কারন, ভালো নির্বাচন আমরা অতীতে অনেক দেখেছি। ভালো নির্বাচনের পরে ভালো সরকার হয়না। ভালো নির্বাচনের পরে ভালো সরকার দেখতে চাই। যাদের জনগণের কাছে জবাবদিহিতা থাকবে। যারা ব্যক্তিগত ও দলীয় সম্পদ হিসেবে দেশকে ব্যবহার করবে না। সেই রকম সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে, সেজন্য বর্তমান সরকারকে আমরা সময় দিতেও রাজি আছি। ভালো নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার বেশির ভাগ সময়ে স্বৈরশাসক হয়েছিলো। কিন্তু, অনির্বাচিত সরকারগুলি অনেক বেশি গণতন্ত্রমনা ছিলো। অনির্বাচিত সরকারগুলোই জনগণের মতামতের বেশি গুরুত্ব দেয়। তাই, অনির্বাচিত সরকারকে সংস্কারের জন্য সময় দিতে আমাদের আপত্তি নেই। আমরা চাই বর্তমান সরকার যেনো আইন শৃংখলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে পারে, দ্রব্যমূল্য যেনো নিয়ন্ত্রণে থাকে, কর্মসংস্থান যেনো থাকে… তাহলে আমাদের অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই। রাজনীতিতে অনেক হিসাব-নিকাশ আছে। আওয়ামী লীগ মাঠে নেই, কিন্তু তাদের একটি সমর্থক গোষ্ঠী আছে। আগামী নির্বাচনে তাদের একটা ভূমিকা থাকবে। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতায় না এসেই তাদের নেতা-কর্মীরা যে অবস্থা সৃষ্টি করেছে তা সাধারণ মানুষ পছন্দ করছে না। রংপুরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের সাথে বিএনপির মুখোমুখি অবস্থা। কেউ দখলবাজী শুরু করলে, ছাত্ররা তার প্রতিবাদ করছে। শেষ পর্যন্ত জনগন কার পক্ষে থাকবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। জাতীয় ছাত্র সমাজকে আরো সংগঠিত হতে হবে। ছাত্র রাজনীতি করতে হবে সুশৃংখল ভাবে। বর্তমানে দেশে বিশৃংখলা আছে, এটা চলতেই থাকলে জনগণ এই সরকারের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠবে। আবেগ ও জীবন দিয়ে দেশ রক্ষা করা যায় কিন্তু দেশ চালানো যায় না। দেশ চালাতে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দরকার হবে। এককভাবে ছাত্ররা দেশ রক্ষা করতে পেরেছে, কিন্তু এককভাবে ছাত্ররা দেশ চালাতে পারবে না। জাতীয় ছাত্র সমাজকে আরো সংগঠিত এবং আরো ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলের, ১৯৯০ সালে আমাদের নেতা, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তিন জোটের রুপরেখা অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। কথা ছিলো সবাই মিলে একটি সুন্দর নির্বাচন করবো। পরে দেখা গেলো হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টিকে নির্বাচন করতে দেয়া হবেনা এমন ষড়যন্ত্র শুরু হলো। গণমানুষের আন্দোলনের মুখে, বিশেষ করে রংপুরের মানুষের অন্দোলনের ফলে এরশাদ সাহেবকে নির্বাচন করতে দেয়া হলো। নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জেলে থেকেই ৫টি আসনে, মোট ৩৪টি আসনে জয়ী হয়েছিলো জাতীয় পার্টি। প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় পার্টি ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের গালাগাল করা হতো। জনগণের ভোটে বিজয়ীদের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা দেখানো হয়নি তখন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামে অসংখ্য মামলা দেয়া হয়েছিলো। হত্যার ১৫ বছর পরে মঞ্জুর হত্যায় মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছিলো হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামে। এই মামলায় অন্তত ২০ বার রায় ঘোষণার আগে বিচারক পরিবর্তন করে আবারো মামলা চালু রাখা হয়েছিলো। সেই মিথ্যা মামলা নিয়েই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মৃত্যু বরণ করেছেন। বিএনপির আমলে দেয়া মঞ্জুর হত্যা মামলা দিয়ে আওয়ামী লীগ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ব্ল্যাক মেইল করেছিলো।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি যখন কেয়াটেকার পদ্ধতি বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলো, আমরা তখন জামায়াত ও আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন বর্জন করেছিলাম। ১৯৯৬ সালের জুনে যখন আবারও নির্বাচন হলো, তখন আওয়ামী লীগ আমাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিলো। আমরা তখন জনগনের ইচ্ছার প্রতি সম্মান রেখেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিলাম। পরে, আওয়ামী লীগই আমাদের দলকে দ্বিখন্ডিত করেছিলো। আমরা তখন সরকারের বিরোধীতা করতে চারদলীয় জোট করেছিলাম। ২০০১ সালের নির্বাচনেও আমরা এককভাবে নির্বাচন করে ১৪টি আসনে জিতেছিলাম। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি দুর্নীতিতে চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো, তারা র্যাব প্রতিষ্ঠা করে বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড করেছিলো। বিচারবর্হিভূত ভাবে মানুষ হত্যা কথনোই সমর্থনযোগ্য নয়। ২০০৬ সালের পর দলীয়করণের মাধ্যমে বিএনপি নিজেদের লোক দিয়ে তত্বাবধায়ক সরকার তৈরী করেছিলো। তখন আবারো আন্দোলন হলে ওয়ান-ইলেভেন আসে। অওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলই নির্বাচন ব্যবস্থা প্রভাবিত করে কারচুপির মাধ্যমে জয়ী হতে চেয়েছিলো। দুটি দলই বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড চালিয়েছিলো।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলো। দেশীয় আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশংসিত হয়েছে সেই নির্বাচন। কিন্তু, দেখা গেছে ব্যাপক জনপ্রীয়তা নিয়ে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিছিলো। দুর্নীতি ও দুঃশাসনে মানুষকে অস্থির করেছিলো। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচন ব্যবস্থা নিজেদের মত করেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন জাতীয় পার্টি বর্জন করেছিলো। ৩০০ জন প্রার্থীর মধ্যে ২৭০ জন প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছিলো, আমি নিজেও নির্বাচন করিনি। আমরা সব সময় জনগনের পক্ষে ছিলাম। জনগনের মতামত বিবেচনা করেই আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিরোধীতা করেছিলাম। ১৪ সালে আওয়ামী লীগ ব্ল্যাকমেইল করে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নিয়েছিলো। জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কিন্তু বিএনপি অংশ নিয়েছিলো।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ সকল দল অংশ নিয়েছিলো, আমরাও নির্বাচনে গিয়েছিলাম। ২০২৪ সালের নির্বাচনে আমরা যেতে চাইনি। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। তারপরও আমরা নির্বাচনে যেতে চাইনি, তখন জোর করে আমাদের নির্বাচনে নেয়া হয়েছে। আমাদের অফিস ফেরাও করে রাখা হয়েছিলো, আমরা যাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে না পারি। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর আমরা সরকারের দুর্নীতি, টাকা পাচার, ব্যাংক লুট, নিজেদের অর্থায়নে যে পদ্মাসেতু করা হয়নি তা সংসদে ও সংসদের বাইরে আমরা বলেছি। আমরা নির্বাচনে না গেলে নির্বাচন বন্ধ হতো? আমরা নির্বাচনে না গেলে আওয়ামী লীগ সরকার কি টিকতো না? আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে সরকারের দুঃশাসনের জন্য। চাকরিতে কোটা পদ্ধতি, মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ বলে মানুষের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করেছিলো আওয়ামী লীগ। দেশের মানুষের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টির জন্যই আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে।
অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ, এ্যাড. মোঃ রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, জহিরুল ইসলাম জহির, শেরীফা কাদের, মাসরুর মওলা, জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া, আরিফুর ইসলাম খান, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মোঃ খলিলুর রহমান খলিল, মইনুর রাব্বী চৌধুরী রুম্মন, মোঃ মোস্তফা মহসিন, ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ সেলিম, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হুমায়ুন খান, মোঃ আব্দুল হান্নান, এমএ রাজ্জাক খান, ইঞ্জিনিয়ার এলাহান উদ্দিন, এমএ সুবহান, মাহমুদ আলম, সমরেশ মন্ডল মানিক সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
Leave a Reply