বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৪ অপরাহ্ন

জীবনের পথ থেকে 

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮.০০ এএম

স্বদেশ রায়

এক সময়ের এই নদী নালার পূর্ব বাংলার বাতাসেও একটা অদ্ভূত গন্ধ ছিলো। জল ভরা বিল,  স্রোত বয়ে যাওয়া খাল. নদীকূল ছাপানো জলে ভরা উদাসী নদী – এর ওপর দিয়ে বা পাশ দিয়ে চলতে গেলে কোথা থেকে যেন একটা আলাদা গন্ধ শুধু নাক জুড়ে নয়, সারা শরীরে মেখে যেতো।

নানান পরিবর্তন, বিবর্তন, সর্বোপরি জীবনের জটিলতা সব মিলে শুধু পরিবেশ থেকে নয়, জীবন থেকেও হারিয়ে গেছে সেই গন্ধ । তখনকার ছোট ছোট শহরগুলোর বাইরে দু পা ফেললেই পাওয়া যেতো সেই বাংলাকে।

এই বাংলার পরিপূর্ণ রূপের বর্ণনার কোন ইতিহাস নেই,  আর ডকুমেন্টারি তো নেই। তবে একেবারেই যে নেই তা নয়। অনেকের আত্মজীবনীর মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় খন্ড খন্ড সেই বাংলার ছবি।

যেমন অতীতের ঢাকার অনেক ইতিহাস আছে। তবে শব্দের মাঝে অতীতের ঢাকার রূপ দেখতে গেলে পরিতোষ সেনের “জিন্দাবাহার লেনের” ভেতর দিয়ে দেখতে হয়। যেখানে শুধু জীবন, মানুষ আর সময় নয়- সব কিছু মিলে সে সময়ের একটা ছবি দেখা যায়। যাকে বলা যেতে পারে শব্দের চলচ্চিত্র।

পূর্ব বাংলার এই ছবি যা শব্দের চলচ্চিত্রে আটকে আছে- তেমন একটি পরিপূর্ণ চলচ্চিত্র পল্লীকবি জসিমউদ্দিন এর আত্মজীবনী। সেখানে শুধু একজন মানুষের বা একজন কালজয়ী ভিন্ন ধারা কবির বেড়ে ওঠা নয়। সেখানে প্রতিটি শব্দের গায়ে যেন সেই হারিয়ে যাওয়া সবুজ, সরল, শান্ত বাংলার একটা গন্ধ মিশে আছে।

শুধু ওই গন্ধ নয়, ওই ছবি নয়, তার আত্মজীবনীই বলে দেয় জীবনের পথে পথে কোথা থেকে তিনি তার কবিতার বোধ, শব্দ ও চিত্রকল্প পেয়েছেন। কোন প্রকৃতি, কোন মানুষ তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। দুঃখ পেতে শিখিয়েছে, দুঃখ দিতে শিখিয়েছে।

যেমন রবীন্দ্রনাথের চিত্রনাট্যের চরিত্র যখন অভিশপ্ত হয়  তখন সে অভিশাপ ছিলো- যাও মর্তে, দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে। দুঃখ দেবার থেকে দুঃখ পাওয়া এবং সেই দুঃখ মেনে নিয়ে পথ চলাই পৃথিবীতে সব থেকে কঠিন অথচ সত্য। জসীমউদ্দিন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ তিন জনকেই কঠিন দুঃখকে বার বার প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে।

নজরুল ওই ভাবে তার আত্মজীবনী লিখে যাবার সময় পাননি। কারণ, তার জীবন সত্যি অর্থে একটা অসমাপ্ত জীবন। তবে তারপরেও গবেষকরা, তার ঘনিষ্ট বন্ধু, অচিন্ত কুমার, শৈলজানন্দ প্রমুখ খ্যাতিমান সাহিত্যিকরা তাকে নিয়ে- তারা তাদের যে বন্ধুকে দেখেছেন সেই বন্ধু নজরুলের কথা লিখেছেন। লিখেছেন এক অসামন্য প্রতিভার কথা। কমরেড মোজাফফর আহমদ ও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের লেখা নজরুল- এ বেশি পাওয়া যায় লেখক নজরুলকে। কিন্তু তাঁর বন্ধুর লেখা নজরুলে পাওয়া যায় রাঢ় বঙ্গে বেড়ে ওঠা এক দূরন্ত কিশোর থেকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ কত কঠিন ভাবে ফেলতে হয়েছে তাকে সেই সত্যকে। অনেক বড় মানুষ থেকে শুরু করে পাবলিশার্সরাও তাঁকে বার বার ঠকিয়েছেন। দুঃখ পেয়েছেন তিনি। কিন্তু সেখানেও যেন তাঁর জীবন রবীন্দ্রনাথের ওই জীবন বোধের ওপর দাঁড়িয়ে, তোমার অসীমে … কোথাও দুঃখ… বিচ্ছেদ… নেই।

আবার জীবনের ভালো ও মন্দকে সমানভাবে মেনে নিয়ে নজরুল জীবনের প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি করেছেন। সামনে এগিয়েছেন। থেমে থাকেননি কখনও। নিয়ে যাননি নিজের চিন্তাকে বাস্তবতার বাইরে।

বাস্তবতার বাইরে যেমন তাঁদের সাহিত্য যায়নি। তেমনি তাঁরাও বার বার বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। এবং এখানে একটি বিষয় খুবই বড় ভাবে সামনে আসে- বাস্তব বোধটি মানুষের সহজাত। কখনও কখনও আবেগ বা অন্যকিছু সেখান থেকে মানুষকে হয়তো একটু ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। কিন্তু শেষ অবধি বাস্তব বোধই সত্য হয়।

জসীমউদ্দিনের বাড়ির পাশেই ছিলো অপূর্ব সুন্দরী এক দরিদ্র কৃষকের অশিক্ষতা কন্য। কবির ভালো লাগতো তাকে। একবার কোলকাতা থেতে বাড়ি এসে দেখেন ওই মেয়ের এক কৃষি শ্রমিকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে। আরেকবার বাড়ি এসে দেখেন, মেয়েটির সেই স্বামী মারা গেছে। কবি একটু দুর্বল হন। কিন্তু মেয়েটি অতি সহজে বলে, আপনি অনেক বড় মানুষ। আমাদের জীবন ভিন্ন।

গ্রামের ওই অশিক্ষিতা কৃষক কন্যার বোধ মিলে যায় রবীন্দ্রনাথের বাস্তব বোধের সঙ্গে। গন্ড গ্রামে এসে অনাথিনী রতনকে অনেকটা বোনের স্নেহ দিয়েছিলো তাঁর পোস্ট মাস্টার গল্পের নায়ক। তার কাছে বলতো তার কোলকাতার বাড়ির গল্প। অথচ বদলী নিয়ে চলে যাবার সময় রতন বোনের দাবীতে বলেছিলো, আমাকে নিয়ে যাবে না দাদাবাবু? পোস্ট মাস্টার উত্তর দেয়- সে হয়না। তার বদলে পোস্ট মাস্টার তাকে একটা আধুলি দেয় আর বলে, নতুন বাবুকে তোর কথা বলে যাবো।

গ্রামের ওই কৃষানী কন্যা আর রবীন্দ্রনাথ দুজনেই যেন একই ভাষায় পৃথিবীর বাস্তবতায় যার যার অবস্থানকে বুঝিয়ে দেয় একইভাবে। কোনভাবেই এ অবস্থান পরিবর্তনের নয়, আর তা উচিত নয়।

লেখকঃ সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024