শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:৩৯ পূর্বাহ্ন

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ১৩ তম কিস্তি )

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

কিন্তু প্রেম তো থাকে না। আসল জিনিসটাই তো মরে যায়! তারপর মানুষের সুখ সম্ভব কি করে?’

‘সুখ হল শুটকি মাছ-মানুষের জিভ হল আসলে ছোটলোক। তাই কোন রকমে সুখের স্বাদ দিয়ে জীবনটা ভরে রাখা যায়। জীবনে বড় নীরস আনন্দ-বড় নিরুৎসব। জীবনের গতি শ্লথ, মন্থর। ঝিমিরে ঝিমিয়ে মানুষকে জীবন কাটাতে হয় তার মধ্যে ওই প্রেমের উত্তেজনাটুকু তার উপরি লাভ।’

‘সুখ হল-? শুটকি মাছ। আগে যেন কার কাছে কথাটা শুনেছি।’ ‘তোমার মা খানিক আগে আমাকে বোঝাচ্ছিলেন।’

‘হ্যা, মা-ই বলছিল বটে। কিন্তু আপনি এমন সব কথা বলছেন যা শুনলে কান্না আসে।’

হেরম্ব একটি পা একধাপ নিচে নামিয়ে বলল, ‘কান্না এলে চলবে না আনন্দ, হাসতে হবে। বুক কাঁপিয়ে যে দীর্ঘশ্বাস উঠবে তার সবটুকু বাতাস হাসি আর গানে পরিণত করে দিতে হবে। মানুষের যদি কোন ধর্ম থাকে, কোন তপক্ষার প্রয়োজন থাকে, সে ধর্ম এই, সে তপস্যা এই। মানুষ কি করবে বল? পঞ্চাশ-ষাট বছর তাকে বাঁচতে হবে অথচ তার কাজ নেই।’

কাজ নেই?’

‘ ‘কোথায় কাজ? কি কাজ আছে মানুষের? অঙ্ক কষা, ইঞ্জিন বানানো, কবিতা লেখা? ওসব তো ভান, কাজের ছল। পৃথিবীতে কেউ ওসব চায় না। একদিন মানুষের জ্ঞান ছিল না, বিজ্ঞান ছিল না, সভ্যতা ছিল না, মানুষের কিছু এসে যায়নি। আজ মানুষের ওসব আছে কিন্তু তাতেও কারো কিছু এসে যায় না। কিন্তু মানুষ নিরুপায়। তার মধ্যে যে বিপুল শূন্যতা আছে সেটা তাকে ভরতেই হবে। মানুষ তাই জটিল অঙ্ক দিয়ে, কায়দাদুরস্ত ভাল ভাল ভাব দিয়ে, ইস্পাতের টুকরো দিয়ে, আরও সব হাজার রকম জঞ্জাল দিয়ে সেই ফাঁকটা ভরতে চেষ্টা করে। পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখো, জীবন নিয়ে মানুষ কি হইচই করছে, কি প্রবল প্রতিযোগিতা মানুষের, কি ব্যস্ততা! কাজ! কাজ! মানুষ কাজ করছে! বৌকে কাঁদিয়ে বিজ্ঞানী খুঁজছে নূতন ফরমূলা, আজও খুঁজছে কালও খুঁজছে। দোকান খুলে বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে চারিদিকে ছেয়ে ফেলে, ঊর্ধ্ব শ্বাসে ব্যবসায়ী করছে টাকা। ঘরের কোণে প্রদীপ জ্বেলে বসে বিদ্রোহী কবি লিখছে কবিতা, সারাদিন ছবি এঁকে আর্টিস্ট ওদিকে মদ খেয়ে ফেনাচ্ছে জীবন। কেউ অলস নয় আনন্দ, কুলি মজুর গাড়োয়ান তারাও প্রাণপণে কাজ করছে। কিন্তু কেন করছে আনন্দ? পাগলের মতো মানুষ খালি কাজ করছে কেন? মানুষের কাজ নেই বলে। আসল কাজ নেই বলে। ছট্‌ফট করা ছাড়া আর কিছু করার নেই বলে।’

‘কিন্তু আসল কাজটা কি? মানুষের যা নেই?’ ‘এ প্রশ্নেরও জবাব নেই আনন্দ। মানুষের কি নেই তাও মানুষের বুঝবার উপায় নেই। কাজ না পেয়ে মানুষ অকাজ করছে এটা বোঝা যায় কিন্তু তার কাজ কি হতে পারত তার কোন সংজ্ঞা নেই। এর কারণ কি জান? মানুষ যে স্তরের, তার জীবনের উদ্দেশ্য সেই স্তরে নেই। ঈশ্বরের মতো, শেষ সত্যের মতো, আমিত্বের মানের মতো সেও মানুষের নাগালের বাইরে। জীবনের একটা অর্থ এবং পরিণতি অবশ্বই আছে, বিশ্ব-জগতে কিছুই অকারণ হতে পারে না। সৃষ্টিতে অজস্র নিয়মের সামঞ্জস্য দেখলেই সেটা বোঝা যায়। কিন্তু জীবনের শেষ পরিণতি জীবনে নেই। মানুষ চিরকাল তার সার্থকতা খুঁজবে, কিন্তু কখনো তার দেখা পাবে না। যোগী ঋষি হার মানলেন, দার্শনিক হার মানলেন, কবি হার মানলেন, অমার্জিত আদিমধর্মী মানুষও হার মানলে। চিরকাল এমনি হবে। কারণ সমগ্র সত্তাকে যা ছাড়িয়ে আছে, মানুষ তাকে আয়ত্ত করবে কি করে!’

কথা বলার উত্তেজনায় হেরম্বর সাময়িক বিস্মৃতি এসেছিল। শব্দের মোহ তার মন থেকে আনন্দের মোহকে কিছুক্ষণের জন্যে স্থানচ্যুত করেছিল। জীবন সম্বন্ধে বক্তব্য শেষ করে পুনরায় আনন্দের সান্নিধ্যকে পূর্ণমাত্রায় অনুভব করে সে এই ভেবে বিস্মিত হয়ে রইল যে শ্রোতা ভিন্ন আনন্দ এতক্ষণ তার কাছে আর কিছুই ছিল না। আনন্দকে এতক্ষণ সে এমনি একটা সাধারণ পর্যায়ে ফেলে রেখেছিল যে শ্রবণশক্তি ছাড়া ওর আর কোন বিশেষত্বের সম্বন্ধেই সে সচেতন হয়ে থাকেনি। হেরম্ব বোঝে, বিচলিত হবার মতো ত্রুটি অথবা অসঙ্গতি এটা নয়। কিন্তু ছেলেমানুষের মতো তবু সে আনন্দের প্রতি তার এই তুচ্ছ অমনোযোগে আশ্চর্য হয়ে যায়।

হেরম্ব এটাও বুঝতে পারে, তার কাছে জীবনের ব্যাখ্যা শুনতে আনন্দ ইচ্ছুক নয়। জীবন কি, জীবনের উদ্দেশ্য আছে কি নেই, এসব তত্ত্বকথায় বিরক্তি বোধ হচ্ছিল। অন্য সময় বিশ্লেষণ ওর ভাল লাগে কিনা হেরম্ব জানে না, কিন্তু আজ সন্ধ্যায় তার মুখের বিশ্লেষণ ওর কাছে শাস্তির মতো লেগেছে। সে থেমে যেতে আনন্দ স্বস্তি লাভ করেছে। রোমিও জুলিয়েটের কথা বলুক, প্রেমের ব্যাখ্যা করুক, আনন্দ মন দিয়ে শুনবে। কিন্তু সেখানেই তার ধৈর্যের সীমা। অনুভূতির সমন্বয় করা জীবনের সমগ্রতাকে সে জানতে চায় না, বুঝতে চায় না, ভাবতে চায় না।

তাই হোক। তাই ভাল। হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘চন্দ্রকলা নাচটা কি আনন্দ?’

আনন্দ বলল, ‘ধরুন, আমি যেন মরে গেছি। অমাবস্যার চাঁদের মতো আমি যেন নেই। প্রতিপদে আমার মধ্যে একটুখানি জীবনের সঞ্চার হল।

ভাল করে বোঝা যায় না এমনি একফোঁটা একটু জীবন। তারপর চাঁদ যেমন কলায় কলায় একটু একটু করে বাড়ে আমার জীবনও তেমনি করে বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে যখন পূর্ণিমা এল, আমি পূর্ণমাত্রায় বেঁচে উঠেছি। তারপর

একটু একটু করে মরে-‘

‘এ নাচ ভাল নয়, আনন্দ।’

‘কেন?’

‘একটু একটু করে মরার নাচ নেচে তোমার যদি সত্যি সত্যি মরতে ইচ্ছা হয়?’

আনন্দ একটু হাসল। ‘মরতে ইচ্ছা হবে কেন? ঘুম পায়। এক মিনিটও তারপর আমি আর দাঁড়াতে পারি না। কোন রকমে বিছানায় গিয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়েই নাক ডাকাতে আরম্ভ করে দি। মা বলে-‘

‘কি বলে?’

‘আপনাকে বলতে লজ্জা হচ্ছে।’

‘চোখ বুজে আমি এখানে নেই মনে করে বল।’

‘না, দুর! সে বলা যায় না।’

হেরম্ব মৃদু হেসে বলল, ‘প্রথম তোমাকে দেখে মনে হয়নি তুমি এত ভীরু। এটা তোমার ভয় না লজ্জা, আনন্দ?’

আনন্দ বলল, ‘মানুষকে আমি ভয় করিনে।’

‘ তবে তুমি ছেলেমানুষ-লাজুক।’

‘ছেলেমানুষ? আমায় একথা বললে অপমান করা হয় তা জানেন?’ আনন্দ হঠাৎ হেসে উঠে হাত বাড়িয়ে হেরম্বের হাঁটুতে টোকা দিয়ে বলল, ‘আমার অনেক বয়স হয়েছে। আমাকে সম্ভ্রম করে কথা কইবেন।’ হেরম্ব জানে, এসব ভূমিকা। তার নাচ সম্বন্ধে মালতী কি বলেছে আনন্দ তা শোনাতে চায়, কিন্তু পেরে উঠছে না। হেরম্ব মৃদু হেসে অবজ্ঞার সুরে বলল, ‘ছেলেমানুষকে আবার সম্ভ্রম করব কি?’

‘ছেলেমানুষ হলাম কিসে?’

‘ছেলেমানুষরাই একটা কথা বলতে দশবার লজ্জা পায়।’

আনন্দ উদ্ধত সাহসের সঙ্গে বলল, ‘লজ্জা পাচ্ছে কে? আমি? জগতে এমন কথা নেই আমি যা বলতে লজ্জা পাই। নাচার পর আমার ঘুম দেখে মা বলে, তোর আর বিয়ের দরকার নেই আনন্দ।’

বলে আনন্দ হঠাৎ উদ্ধৃতভাবে হেরম্বকে আক্রমণ করল, বলল, ‘আপনি নেহাত অভদ্র। মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করতে জানেন না।’ মনে হয় সে বুঝি হঠাৎ উঠে চলে যাবে। হেরম্বের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ ভঙ্গীতে সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ঠোঁট দুটি কাঁপতে থাকে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024