জীবনকথা
আর একটি ছেলে সূর্যের দিকে চাহিয়া আছে। মাস্টার মহাশয় তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া আমার পিতাকে সালাম করিলেন। আর-আর ছাত্রেরাও উঠিয়া দাঁড়াইল। যাহারা নিলডাউন হাফ নিলডাউন হইয়া শাস্তি পাইতেছিল তাহারাও শাস্তি হইতে রেহাই পাইল। আমার পিতার যে এত সম্মান তাহা আগে জানিতাম না। গর্বে আমার বুক তিন হাত হইল। কিছুক্ষণ মাস্টার মহাশয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলিয়া বাজান চলিয়া গেলেন। মাস্টার মহাশয় আমাদিগকে বড়ই স্নেহের চোখে দেখিলেন। বলিয়া দিলেন, কাল হইতে দোয়াত কলম ও কলাপাতা লইয়া আসিও। স্কুলের ছুটি হইলে আমি আর নেহাজদ্দীন বাড়ি ফিরিবার পথে বলাবলি করিতে লাগিলাম, নারে, পাঠশালা তো তত খারাপ নয়। কাল আবার আসিব।
মাস্টার মহাশয় আমাদিগকে মারিবেন না। বাড়ি আসিয়া দেখি মা পথের দিকে চাহিয়া আছেন। আমি যেন কোন দেশ জয় করিয়া দেশে ফিরিয়াছি, মায়ের চোখে-মুখে এই ভাব। কত আদর করিয়া মা নিজের হাতে ধরিয়া ধরিয়া আমাকে তাঁর সদ্য তৈরি পাকানো পিঠাগুলি খাওয়াইলেন। পরের দিন সকাল না হইতে নদীর ধারে যাইয়া কাশবনে ঢুকিয়া লাল রঙের সুন্দর দুইটি খাগের ডাঁটা কাটিয়া আনিলাম। আমার বড় ভাই তাহা কাটিয়া আমাদের দুইজনের জন্য দুইটি খাগের কলম বানাইয়া দিলেন। তারপর লাউপাতায় পানি মিশাইয়া হাঁড়ি-পাতিলের পিঠের কালিতে ঘষিয়া কালি তৈরি করিলাম। বাড়িতে অসংখ্য কলাগাছ ছিল। সুতরাং কলাপাতা কাটিয়া সাইজমতো চিরিয়া লইতে অসুবিধা হইল না।
পাঠশালায় আসিয়া দেখি, মাস্টার মহাশয় এখনও আসিয়া পৌঁছেন নাই। ছেলেরা সারাটি গ্রাম ঘুরিয়া এ-বাড়ি সে-বাড়ি হইতে গাছের ফল পাড়িয়া আনিয়া খাইতেছে। কেহ কেহ মাঠে যাইয়া কলাইয়ের শিম টুকাইতেছে, কেহ কেহ দল বাঁধিয়া খেলা করিতেছে। কিন্তু সকলেরই লক্ষ্য আছে মাস্টার মহাশয় কখন আসেন। রোজ যে-পথ দিয়া তিনি আসেন সে-পথে পাহারা বসা আছে। দূর হইতে মাস্টার মহাশয়কে দেখিয়াই তাহারা আর সব ছেলেদের খবর পাঠায়। সেদিন দুপুরবেলায় এরূপ খবর পাইয়া, কোনো ছেলে পেয়ারা খাইতে খাইতে, কোনো ছেলে তার আধেক খাওয়া আখের খণ্ডটি যথাস্থানে লুকাইয়া রাখিতে রাখিতে, কোনো ছেলে পান খাওয়া মুখ ধুইতে ধুইতে, কোনো ছেলে সদ্য তামাক খাওয়া মুখে কয়েকটি পেয়ারা পাতা চিবাইতে চিবাইতে, পাঠশালার ঘরে আসিয়া যার যার পড়ায় মনোযোগ দিল।
তাহাদের সুউচ্চ পড়ার ধ্বনিতে পাঠশালা ঘরের চালা কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল। মাস্টার মহাশয় খুশি হইয়া চেয়ারে আসিয়া বসিলেন। দুইটি ঢেঙা ছেলে দুইপাশ হইতে দু’খানা তালের পাখা লইয়া মাস্টার মহাশয়কে বাতাস করিতে লাগিল। আর দুইজন ছুটিল মাস্টার মহাশয়ের জন্য তামাক সাজিয়া আনিতে। অনেকক্ষণ তামাক টানিয়া মাস্টার মহাশয় বড় বড় ছেলেদের পড়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। যেসব আধেক বয়সী ঢেঙা ঢেঙা ছেলেদের আমরা কেউকেটা বলিয়া মনে করিতাম, পড়া না পারার জন্য মাস্টার মহাশয় তাহাদের মারিয়া অস্থির করিলেন। কাউকে কাউকে নিলডাউন ও হাফ নিলডাউন হইয়া পড়া তৈরি করিয়া আনিতে বলিলেন।
এইবার আমার ও নেহাজদ্দীনের পালা। আমাদের আনা কলাপাতার উপর তিনি স্লেট পেন্সিল দিয়া সবগুলি বর্ণমালা লিখিয়া দিয়া বলিলেন, ইহার উপরে কালি দিয়া দাগ দিতে থাক। বলা বাহুল্য অপটু হাতে কালিতে কলম ডুবাইয়া সেই কলাপাতার উপর কলম চালাইতে মাঝে মাঝে অক্ষর আঁকা রেখাগুলির ডাইনের বামের বহুস্থানই শুধু কলঙ্কিত করিলাম না, আমার হাতের আঙুলগুলির সঙ্গে জামা-কাপড়ও কলঙ্কিত হইয়া উঠিল। এইভাবে আমরা পড়াশুনা করিতেছি, ও-পাড়া এ-পাড়া হইতে কত জন আসিয়া নালিশ আরম্ভ করিল, মাস্টার মহাশয়, আপনার পাঠশালার অমুক আমার আখের ক্ষেত হইতে আখ চুরি করিয়া আনিয়াছে, অমুক আমার গাছের পেয়ারা চুরি করিয়াছে, রাশি রাশি পেয়ারাসহ গাছের ডালখানা ভাঙিয়া আনিয়াছে, অমুক আমার শসাগাছের জালিশসাটি ছিঁড়িয়া আনিয়াছে।
Leave a Reply