জীবনকথা
এক-একজনের জবানবন্দি লইয়া মাস্টার মহাশয়ের বেত সমানে অপরাধীদের পিঠে পড়িতে লাগিল। এমনি করিয়া রোজ পাঠশালার পড়াশুনা চলিত। বাহির হইতে মাস্টার মহাশয়কে বড়ই কঠোর মনে হইত কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে বড়ই স্নেহপ্রবণ হইতেন। ছাত্রদের সুখ-দুঃখের কাহিনী শুনিতেন। যাহারা বেতন দিতে পারিত না তাহাদিগকে তিনি স্কুল হইতে তাড়াইয়া দিতেন না। আমাদের পাঠশালায় গভর্নমেন্টের কোনোই সাহায্য ছিল না। ছাত্র-বেতনে মাত্র দুই টাকা আড়াই টাকার মতো আদায় হইত। নিজের ঘর-সংসারের কাজ সারিয়া মাস্টার মহাশয় স্কুলে পড়াইতে আসিতেন। তাই সময়মতো আসিয়া উপস্থিত হইতে পারিতেন না।
পাঠশালায় যাহারা মনোযোগী ছাত্র ছিল তাহাদিগকে তিনি বড়ই আগ্রহ করিয়া পড়াইতেন। তাঁর স্কুল হইতে বহুবার ছাত্রেরা জলপানি পাইয়াছে। কিন্তু সেজন্য মাস্টার মহাশয়ের কোনোই উন্নতি হয় নাই। হিন্দুপাড়ার এই পাঠশালা আমার কাছে বড়ই আকর্ষণের বস্তু হইয়া উঠিল। হিন্দুদের বাড়িতে বাড়িতে নানারকম ফুলের গাছ। শীতকালে রক্তগাঁদা আর বড় গাঁদার রঙে আর গন্ধে উঠানের অর্ধেকটা আলো হইয়া থাকে। গাঁদা ফুলের চাইতেও সুন্দর হিন্দু বউরা কপালভরা সিঁদুর পরিয়া উঠানের ওপর সুনিপুণ করিয়া চালচিত্র আঁকিত। কার্তিক পূজা লক্ষ্মীপূজায় জোকার দিয়া শঙ্খ বাজাইত। বিবাহের উৎসবে ঢোল সানাই বাজিত। আমাদের মুসলমান পাড়ায় গান-বাজনা নাই।
কারও বাড়িতে ফুলের গাছ নাই। ওহাবী আন্দোলনের দাপটে গ্রাম হইতে আনন্দ-উৎসব লোপ পাইয়াছে। আমি আমার হিন্দু বন্ধুদের বাড়ি হইতে চাহিয়া-চিন্তিয়া ফুলের গাছ, পাতাবাহারের ডাল আনিয়া বাড়িতে লাগাইতাম। গাছগুলিকে কতই না যত্ন করিতাম। কিন্তু ফসল কাটার সময় আসিলে তাহার উপরে রাশি রাশি খড় মেলিয়া শুকানো হইত। কৃষাণদের অসাবধান পায়ের তলায় কত গাছের ডালগুলি ভাঙিয়া যাইত। আমি চিৎকার করিয়া কাঁদিতাম। একটা ফুলের গাছ ভাঙার জন্য যে কেহ দুঃখ পাইয়া কাঁদিতে পারে একথা বাড়ির কেহই বুঝিত না। এমনি করিয়া উঠানের ধারে বাগান করায় ব্যর্থ হইয়া আমাদের কলাবাগানের জঙ্গলের মধ্যে একটি জায়গা কোপাইয়া ফুলের বাগান করিলাম।
একে তো সেখানে রৌদ্র নাই, তার উপরে গাছের তলায় সব সময় ছায়া করিয়া আছে। ফুলের গাছ তেমন জোর ধরিয়া ফুল ফোটাইল না। কিন্তু কয়েকটি পাতাবাহারের ডাল রং-বেরঙের পাতা মেলিয়া ঝলমল করিয়া উঠিল। আমার পরিচিত কেহ বাড়ি আসিলে আমি আগ্রহ করিয়া তাহাকে এই বাগান দেখাইতাম। আমাদের গ্রামে এক কাকচরিত ব্রাহ্মণ আসিতেন। বাড়িতে বাড়িতে যাইয়া তিনি লোকের হাত দেখিয়া গোনাপড়া করিতেন। তিনি গ্রামে আসিলেই আমি তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিতাম। গ্রামের কেহ তাঁহার নিন্দা করিলে আমি গোপনে তাঁহাকে বলিয়া দিতাম। সেই নিন্দুক লোকটির ভাগ্য গনিতে তিনি ঐ নিন্দার কথা বলিয়া দিতেন। লোকে বলাবলি করিত, দেখ, ঠাকুরের কত কেরামতি।
মনের কথা জানিতে পারে। এই ঠাকুর আমাকে বড়ই ভালোবাসিতেন। একবার আমি এই ঠাকুর মহাশয়কে আমার বাগান দেখিতে লইয়া গেলাম। পাতাবাহারের গাছগুলি দেখিয়া তিনি বড়ই খুশি হইলেন। আমাকে কানেকানে বলিয়া দিলেন, এই গাছগুলির কাছে আসিয়া তুমি মনে মনে বলিবে, এই পাতাবাহারের মতো সুন্দর একটি বউ যেন আমার হয়। এরপর এই পাতাবাহারের গাছে পানি দিতে আসিয়া কেমন যেন লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিতাম। হয়তো মনে মনে দুই একবার বলিতামও, গাছ, তোমার মতো সুন্দর বউ যেন আমার হয়। বিবাহের বাসররাতে নতুন বউকে এই গল্প বলিয়া তার মুখে কিঞ্চিৎ লজ্জামিশ্রিত হাসি উপহার পাইয়াছিলাম। পাঠশালায় আমার এক বন্ধু ছিল বিনোদ।
Leave a Reply