জীবনকথা
সে এখন রাজমিস্ত্রির কাজ করে। তাহাদের বাড়িতে ছিল একটি কালো তুলসীর গাছ। বিনোদ বলিত, এই কালো তুলসীর পাতায় অনেক অসুখ সারে। কারও যদি হাত-পা কাটিয়া যায়, ইহার রস ক্ষতস্থানে দিলেই রক্ত বন্ধ হইয়া যায়। কালো তুলসীগাছের আরও অনেক গুণপনার কথা সে বলিত। আজ তাহা মনে নাই। পাঠশালার ছুটির পরে বিনোদের বাড়ি যাইয়া এই তুলসীগাছটির পানে চাহিয়া থাকিতাম। গাল কালোতে মিশানো পাতাগুলি কতই সুন্দর। কাছে যাইয়া গন্ধ শুঁকিতে প্রাণ ভরিয়া যাইত। বিনোদকে বলিলাম, এই গাছের একটি চারা আমাকে দে।
কিন্তু সে কিছুতেই আমার অনুরোধ রাখিল না। সেবার আমার স্লেট পেন্সিলের অর্ধেকটা ভাঙিয়া দিয়া বহু অনুনয়-বিনয় করিয়া তাহার নিকট হইতে একটি কালো তুলসীর চারা বাড়িতে আনিয়া লাগাইলাম। মুসলমান বাড়িতে তুলসীগাছ লাগাইয়া অনেকের কাছে সমালোচনার পাত্র হইলাম, কিন্তু আমার তুলসীগাছটি যখন বড় হইল তখন ওষধি হিসাবে তাহার পাতা লইতে এ-বাড়ি ও-বাড়ি হইতে যখন লোক আসিত, আমার বুক গর্বে ভরিয়া যাইত। আজও হাটের পথে বিনোদের সঙ্গে যখন দেখা হয়, এই কালো তুলসীগাছটির গল্প বলিয়া আবার আমরা ছেলেবেলায় ফিরিয়া যাই। আমার পিতার দোস্ত ছিলেন জোয়াইড় গ্রামের মনসুর মৌলবি। ইনি ঢাকা হইতে আরবি-পারসি শিক্ষা করিয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামে আসিলে তিনি আমাদের বাড়িতেই আস্তানা গাড়িতেন, আর এ-বাড়ি ও-বাড়ি মিলাদের দাওয়াত রক্ষা করিতেন।
ছোটবেলায় আমি বড়ই নোংরা ছিলাম। মুখ দিয়া সর্বদা লোল পড়িত। কেহই আমাকে কাছে বসিতে দিত না। কিন্তু এই মৌলবি সাহেব কেন যেন আমাকে অত্যধিক স্নেহ করিতেন। নিজের পাতে বসিয়া খাওয়াইতেন। আমার অসাবধান মুখের ভাত তাঁহার পাতে পড়িত। তিনি গ্রাহ্য করিতেন না। আমাদের বাড়ির ধারেকাছে মৌলবি সাহেবের দাওয়াত হইলেও আমি তালেব-এলেম হইয়া তাঁহার সঙ্গে যাইতাম। কিস্তিটুপি মাথায় দিয়া মৌলবি সাহেবের কেতাব কোরান কাঁধে ফুলাইয়া যখন তাঁহার সঙ্গে যাইতাম তখন গর্বে আমার বুক ফুলিয়া উঠিত। মনে মনে বলিতাম, যাহারা আমাকে নোংরা বলিয়া দুর দূর করিয়া তাড়াইয়া দেয় একবার তাহারা চাহিয়া দেখুক, আমি কেউকেটা নই।
বারবার মৌলবি সাহেবের সঙ্গে দাওয়াতে যাইয়া মিলাদের সমবেত দরুদশরিফগুলি আমি বেশ আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিলাম। মিলাদের সময় মৌলবি সাহেবের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাইয়া এই দরুদশরিফগুলি আমি সুর করিয়া পড়িতাম। মৌলবি সাহেব যখন থাকিতেন না, আমি আমার পিতার বইগুলি কাপড় দিয়া বাঁধিয়া গলায় ঝুলাইয়া আমাদের পার্শ্ববর্তী বচন মোল্লার বাড়িতে যাইয়া কৃত্রিম মৌলুদ পড়িতাম। বচন মোল্লা গ্রাম সম্পর্কে ছিলেন আমার দাদা। তাঁর স্ত্রী, বোন ও ভায়ের বউরা সবাই সম্পর্কে আমার দাদি। তাঁহারা আদর করিয়া আমাকে উঠানের মধ্যে মাদুর পাতিয়া বসিয়ে দিতেন।
কলার কচিপাতা দিয়া মোমবাতি বানাইয়া আমার সামনে রাখিতেন। পোলছুরতের বর্ণনা হইতে আরম্ভ করিয়া গোর-আজাব শেষ করিয়া আমি যখন সুর করিয়া গান ধরিতাম মৌলবির মাফেলেতে মোমবাতি চাহিরে মৌলবির মাফেলেতে আতর গোলাপ চাহিরে তখন আমার দাদিরা আতর গোলাপের পরিবর্তে আমার মাথায় বদনা হইতে পানি ছিটাইয়া দিয়া হাসিয়া কুটি কুটি হইতেন। ছোটবেলায় আমার ইচ্ছা ছিল, বয়স হইলে আমি ঢাকায় যাইয়া মৌলবি হইব। মায়ের কাছে অপরাধ করিয়া বকুনি খাইলেই আমি আমার পিতার বইপত্র বোগলে ঝুলাইয়া ঢাকায় রওয়ানা হইতাম। তখনও বাড়ি হইতে বেশি দূরে যাইবার সাহস হয় নাই। আমাদের বাড়ির সামনে ছোনের ক্ষেত।
Leave a Reply