শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:১৯ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৭)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

জীবনকথা

মাঝে মাঝে কুড়ি-পঁচিশ জনের অধিক অতিথি সমাগম হইত। এই অতিথিদিগকে আদর যত্ন করিতে আমার পিতা পাগল হইয়া উঠিতেন। ফরিদপুর হইতে সন্দেশ, রসগোল্লা ও নানারকম মিঠাই আনা হইত। তারই সঙ্গে সকালবেলা কাঁচারসের ক্ষীর, পাকানো পিঠা, দুপুরে ভাতের সঙ্গে ঘি মিশাইয়া পোলাও আর মুরগির গোস্ত। রাত্রেও মাছ ভাত গোস্ত। জুলফিকারের মা অথবা জলার মা আমাদের সম্পর্কে দাদি। তাঁর স্বামী আদালতে চাকরি করিতেন। যাহা উপার্জন করিতেন পোলাও গোস্ত ও ভালো ভালো খাবার খাইয়া শেষ করিতেন। চরভদ্রাসনের কুটুম্ব আসিলেই জলার মার ডাক পড়িত। তিনি আসিয়া মেহমানদের জন্য পোলাও গোস্ত রান্না করিয়া দিতেন। খুব সূক্ষ্ম করিয়া সুপারি কাটিয়া দিতেন।

সে সুপারি এতই সুক্ষ্ম যে সামান্য বাতাস হইলে পানদান হইতে উড়িয়া যাইত। আমার মাও পরে এইরূপ সুপারি কাটা শিখিয়াছিলেন। সেই সুপারি দিয়া জলার মা এক বোঁটায় পাঁচটি পান বানাইয়া দিতেন।  ঝালরের মতো করিয়া একটি ডালের সঙ্গে অনেকগুলি পান আটকাইয়া দিতেন। অতিথিরা খাইয়া ধন্য ধন্য করিতেন। কেহ কেহ দেশে যাইয়া দেখাইবার জন্য সেই সুপারির খানিকটা গামছায় বাঁধিয়া লইতেন। জলার মার সুপারি কাটার সুখ্যাতি এদেশ হইতে আরেক দেশে যাইয়া শত শত লোকের তারিফ কুড়াইয়া আনিত। স্বামী মরিয়া যাইবার পর তাঁর অবস্থা ভালো ছিল না।

কিন্তু তাঁহার এইসব গুণপনার জন্য গ্রামের সকলেই তাঁহাকে খুব সম্মান করিত। কারও বাড়িতে নতুন কুটুম্ব আসিলেই জলার মার ডাক পড়িত। এইভাবে চরভদ্রাসনের কুটুম্বেরা দুই-তিনদিন থাকিয়া চলিয়া যাইতেন। তারপর আমার পিতা ভাবিতে বসিতেন এই কয়দিন কত টাকা খরচ হইয়াছে। ওখানে চিনির দাম বাকি পড়িয়া আছে।  সে দোকানে মিষ্টির দাম পড়িয়া আছে। মা তখন বাজানের সঙ্গে বকরবকর করিতেন। আমি কিন্তু মনে মনে কেবলই বলিতাম, এরূপ কুটুম্ব যেন রোজই আসে। রোজই তাহা হইলে ভালোমতো খাওয়া যাইবে। অতিথিজনকে আদর আপ্যায়ন করিতে আমার পিতা একেবারে বেহুঁশ হইয়া পড়িতেন। একবার একটা জমি বিক্রি করিয়া তিনি শ’দেড়েক টাকা পাইলেন।

তখন বর্ষাকাল। ঘরের ধান ফুরাইয়া গিয়াছে। কিনিয়া খাইতে হইবে। স্থির হইল এই টাকা দিয়া আগামী কয়েক মাসের জন্য চাউল কিনিয়া রাখা হইবে। এমন সময় হোগলাকান্দি হইতে নৌকা করিয়া আমাদের বাড়িতে সাত-আটজন কুটুম্ব আসিলেন। তিন-চারদিন তো তাঁহাদিগকে নানা উপাচারে খাওয়ানো হইলই, যাইবার সময় বাজান তাঁহাদের প্রত্যেককে এক জোড়া করিয়া কাপড় আর ডবল নৌকাভাড়া দিয়া বিদায় করিলেন। তাঁহারা চলিয়া গেলে আমার পিতা মাথায় হাত দিয়া বসিলেন। হায়। হায়।কি করিয়াছি! এই কয়দিনে জমি বেচার সবগুলি টাকা তো খরচ হইয়াছেই, উপরন্তু এখানে-সেখানে আরও কিছু কিছু ধার পড়িয়া আছে। তারপর কি করিয়া তিনি সংসার চালাইয়াছিলেন সেই বয়সে তাহা জানিতে পারি নাই।

 

(চলবে)……..

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024