শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩৩ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮)

  • Update Time : শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

জীবনকথা

চরভদ্রাসনের লোকেরা আমার পিতাকে কেমন ভালোবাসিতেন, একটি দৃষ্টান্ত দিলে বোঝা যাইবে। তখন আমার পিতার মৃত্যু হইয়াছে। গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করিতে আমি একবার এই গ্রামে গিয়াছি।

মোমিন মোল্লা নামক একটি বৃদ্ধ ব্যক্তি আমাকে তাঁর বাড়িতে একদিন নিমন্ত্রণ করিলেন। বৈঠকখানায় খাইতে বসিয়া দেখি, ঘরের ভিতর হইতে হেলিয়া প্রকাণ্ড একটি আমগাছ শাখা বাহু মেলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। আহারের পরে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ তো বড় তাজ্জবের ব্যাপার। ঘরের মধ্যে আমের গাছ লাগাইয়া বাহিরে হেলাইয়া দিয়াছেন।” হাতের হুঁকাটি নামাইয়া রাখিয়া মোমিন মোল্লা বলিতে লাগিলেন, “আজ তিরিশ বছর আগের কথা।

তোমার বাবা আমার বাড়িতে জ্যৈষ্ঠ মাসে বেড়াইতে আসিয়াছেন। যেখানটিতে তুমি বসিয়া আজ খাইলে, ওখানটিতে বসিয়া তিনি আম দুধ খাইয়া আঁটিটি এইখানে ফেলিয়াছিলেন। কয়েকদিন পরে তোমার বাবা যখন চলিয়া গেলেন, ওই আঁটিটি ওখান হইতে আর ফেলিয়া দিলাম না। কিছু মাটি আনিয়া আঁটিটির উপর রাখিয়া দিলাম। দিনে দিনে সেই আঁটি হইতে অঙ্কুর হইয়া আজ এত বড় গাছটিতে পরিণত হইয়াছে। এই গাছের একটি আম যদি তোমাকে আজ খাওয়াইতে পারিতাম কত খুশিই না হইতাম। কিন্তু তুমি অদিনে আসিয়াছ। এখন গাছে আম পাকে নাই।

যদি বাঁচিয়া থাকি, আমের দিনে আসিয়া এই গাছের একটি আম খাইয়া যাইও। তোমার বাপের প্রতি আমাদের যে কতখানি মহব্বত গড়িয়া উঠিয়াছিল, আমি মূর্খ মানুষ, তোমার মতো সুন্দর করিয়া তাহা বলিতে পারিব না, কিন্তু এই গাছটি তার সমস্ত ডাল মেলিয়া দিনরাত আমার সকল কথা বলিতেছে। বাবা জসীম।

আমাদের কাল শেষ হইয়া আসিয়াছে। এই ভালোবাসা যেন তোমাদের কালে যাইয়াও বর্তে।” বৃদ্ধের মুখে এই কাহিনী শুনিতে শুনিতে আমার চোখ দুইটি অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। এমন করিয়া মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন করিতে কোথাও দেখি নাই। আমার সামান্য কবিখ্যাতি হওয়ায় লোকের কাছে কিছু প্রশংসাও পাইয়াছি কিন্তু আজ ভাবিয়া আশ্চর্য হইতে হয়, আমার পিতা তাঁর কোন সেবা দিয়া, কোন ভালোবাসা দিয়া এই মূর্খ গ্রামবাসীটির অন্তরের কোন তারে আঘাত করিতে পারিয়াছিলেন, যে তাহাই আজ শত শাখা-বাহু মেলিয়া ধরিয়া এই মুক আমগাছটি প্রকাশ করিতেছে। পদ্মার ভাঙনে চরভদ্রাসন ভাঙিয়া গিয়াছে। মোমিন মোল্লাও সেই কবে মরিয়া গিয়াছেন। এই গাছটিরও আজ আর কোনো চিহ্ন নাই। এমনি করিয়া কোনোকিছুরই চিহ্ন থাকিবে না। মানুষ তবু বালুর উপরে ঘর বাঁধে।

 

(চলবে)……..

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024