শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:১৯ পূর্বাহ্ন

২৫২ মিলিয়ন বছর আগে: এল নিনোর তাণ্ডবে প্রাণের ধ্বংসযজ্ঞ

  • Update Time : শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৬.৩২ পিএম

সারাক্ষণ ডেস্ক

এই ঘটনাটি গ্রেট ডাইংনামে পরিচিতযা পার্মিয়ান ভূতাত্ত্বিক যুগের শেষের দিকে ঘটেছিল এবং এটি পৃথিবীর ইতিহাসের পাঁচটি বড় বিপর্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। এই ঘটনাটি ডাইনোসরদের ধ্বংসের জন্য দায়ী বিশাল উল্কাপিণ্ডের ঘটনার চেয়েও বেশি ধ্বংসাত্মক ছিল।

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো সাইবেরিয়ান ট্র্যাপস নামে পরিচিত একটি অঞ্চলে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন হঠাৎ করে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয়। রাশিয়ার বর্তমান বিশাল এই এলাকাটি অস্ট্রেলিয়ার সমান ছিল এবং এই নির্গমন উচ্চতর তাপমাত্রাঅ্যাসিড বৃষ্টি এবং মহাসাগরীয় অম্লীকরণের কারণ হয়েছিল।


তবে নতুন এক গবেষণা অনুযায়ীএকটি মেগা এল নিনো প্রভাব — যা বর্তমান জলবায়ু ঘটনাটির চেয়ে অনেক বেশি তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল — এই বিপর্যয়ের মূল কারণ হতে পারে। বৃহস্পতিবার( ১২ সেপ্টেম্বর)  সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় এমনটাই বলা হয়েছে।

গবেষণার সহ-লেখক পল উইগনলযিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ লিডসের প্যালিওএনভায়রনমেন্টসের অধ্যাপকবলেন, “আমরা দেখাচ্ছি যে এটি ছিল একটি জলবায়ু ভিত্তিক বিলুপ্তি সংকট। এটি শুধু উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে নয়বরং জলবায়ু কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সেটাই আসল কারণ।

তিনি আরও বলেন, “যদি পরিস্থিতি খারাপ কিন্তু ধ্রুবক হতোতবে জীবন সেই পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারত। কিন্তু সমস্যাটা হলোদশকের পর দশক ধরে এটি এক চরম অবস্থা থেকে আরেক চরম অবস্থায় দোদুল্যমান হচ্ছিল।

গবেষণা দলটি পার্মিয়ান যুগের শেষের দিকের বৈশ্বিক জলবায়ুর একটি কম্পিউটার মডেল তৈরি করেছিলযা দেখিয়েছিল যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে এল নিনো ঘটনাযা সাধারণত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শুরু হয় কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আবহাওয়ার প্রভাব ফেলেএর তীব্রতা এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়।

এই ঘটনা তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং বন্যা ও খরার পর্যায়ক্রমিক সময় নিয়ে আসেযা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ১ লাখ বছরের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতিকে ধ্বংস করে দেয়।


আজকের এল নিনো যা বাতাসের গতিপথ ও মহাসাগরীয় প্রবাহকে প্রভাবিত করেসাধারণত নয় থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং দুই থেকে সাত বছর পরপর ঘটে। গবেষণার প্রধান লেখক আলেক্স ফার্নসওর্থযিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টলের একজন জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহকারীবলেনপার্মিয়ান যুগের উষ্ণতম পর্যায়ে একটি এল নিনো ১০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতো।

২৫২ মিলিয়ন বছর আগের এল নিনো প্যানথালাসিক মহাসাগরে শুরু হয়েছিলযা আজকের প্রশান্ত মহাসাগরের চেয়ে অনেক বড় ছিল এবং আরও বেশি তাপ ধারণ করতে পারতযা এল নিনো প্রভাবকে শক্তিশালী এবং স্থায়ী করত।

তিনি আরও বলেনআগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ প্রধান কারণ ছিলতবে এটি একাই এই জৈবিক বিপর্যয়ের মাত্রা ব্যাখ্যা করতে যথেষ্ট ছিল না। পৃথিবী এর আগেও একই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেকিন্তু তখন তা গণবিলুপ্তি ঘটায়নি।

উইগনল বলেন, “এখানে মূল কারণ ছিল আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপতবে এটি সমুদ্রের গতিবিদ্যার উপর একটি প্রতিক্রিয়ামূলক প্রভাব ফেলেছিলযা এই শক্তিশালী এল নিনোগুলির বিকাশ ঘটাতে শুরু করে এবং তারপর এরা একসাথে কাজ করে।


গবেষণায় বলা হয়েছেদীর্ঘস্থায়ী এবং তীব্র এল নিনো ঘটনাটি কেন প্রথমে স্থলভাগে বিলুপ্তি শুরু হয়েছিল এবং তারপর মহাসাগরে তা ঘটেছিলসেটিও ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।

সহ-লেখক ইয়াডং সানযিনি চীনের উহানে অবস্থিত চায়না ইউনিভার্সিটি অফ জিওসায়েন্সেসের একজন গবেষকএক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “যখন মহাসাগরগুলি প্রাথমিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলতখন মেগা এল নিনো স্থলভাগের তাপমাত্রা এত দ্রুত বাড়িয়ে দেয় যে অধিকাংশ প্রজাতি এর সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, “শুধুমাত্র যারা দ্রুত অভিবাসন করতে পারততারা বেঁচে ছিলএবং খুব কম সংখ্যক উদ্ভিদ বা প্রাণীই তা করতে সক্ষম ছিল।

পার্মিয়ান যুগের শেষের বিলুপ্তি এত ভয়াবহ হওয়ার একটি মূল কারণ হলো মেগা এল নিনো গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে প্রচণ্ড উষ্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছিলযা দ্রুত উচ্চ অক্ষাংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং অধিকাংশ উদ্ভিদের ধ্বংস ঘটায়যার ফলে তারা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার ক্ষমতা হারায়।

উইগনল বলেন, “এই সময়ে আপনি সব গাছ হারিয়েছেনযা অবিশ্বাস্য। প্রাথমিক ট্রায়াসিকে হাঁটু উচ্চতার বেশি কিছুই বাড়ছিল না।


উচ্চ তাপমাত্রার পরিবর্তন সম্পর্কে পূর্ববর্তী তথ্য উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবাশ্মস্তরকৃত পলল এবং বরফ কোর থেকে পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলির জন্য গাছের রিং এবং প্রবাল ব্যবহৃত হয়। এই ডেটাগুলি কম্পিউটার মডেল তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়যা বিজ্ঞানীদের অতীতের পরিস্থিতি এবং জলবায়ু ব্যবস্থা বুঝতে সাহায্য করে।

ফার্নসওর্থ বলেনতাদের জলবায়ু মডেলটি বিভিন্ন সিমুলেশন চালাতে কয়েক মাস সময় নিয়েছিল এবং এটি আগের মডেলের চেয়ে ভালো ছিল কারণ এতে নতুন এবং বিশদ তাপমাত্রার তথ্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এই তথ্য ছোট ইল-জাতীয় প্রাণী কোনডন্টস” -এর জীবাশ্ম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই তথ্য দেখিয়েছিল যে গণবিলুপ্তির সময় তাপমাত্রা কীভাবে বিভিন্ন অক্ষাংশে বেড়েছিল।

তিনি আরও বলেনকোনডন্টের জীবাশ্মিত দাঁতের উপাদানে দুটি ভিন্ন ধরনের অক্সিজেন আইসোটোপের অনুপাত তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল ছিলএবং এটি গণবিলুপ্তির সময় তাপমাত্রার পরিবর্তনের প্রমাণ সরবরাহ করেছিল।


আলফিও আলেসান্দ্রো কিয়ারেনজাযিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের আর্থ সায়েন্সেস বিভাগের রয়্যাল সোসাইটি নিউটন ইন্টারন্যাশনাল ফেলোবলেনএখন fossil রেকর্ডে প্রমাণ খোঁজা আকর্ষণীয় হবে। বিশেষ করে কীভাবে trilobites, প্রাথমিক উভচরসরীসৃপ সদৃশ স্তন্যপায়ী পূর্বপুরুষ এবং প্রাথমিক কুমিরজাতীয় প্রাণীগুলি এই বিলুপ্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এবং তাদের জীববিদ্যার কোন দিকগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা বের করতে।

তিনি আরও বলেন, “এই গবেষণা জলবায়ু-পরিবেশগত গতিশীলতার কতটা জটিল এবং আন্তঃসংযুক্ত তা আরও একটি উদাহরণ সরবরাহ করে এবং কীভাবে এই ধরনের প্রক্রিয়া বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যকে মৌলিকভাবে প্রভাবিত করতে পারে — যা বর্তমান পরিবেশগত সংকটের আলোকে একটি গুরুতর সতর্কবার্তা।

আজকের দিনে কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে আমরা ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির মধ্যে রয়েছি এবং পার্মিয়ান যুগের শেষের বিলুপ্তি বর্তমান জলবায়ু সংকটের জন্য শিক্ষা সরবরাহ করতে পারে।


গবেষণায় বলা হয়েছেআজকের এল নিনো ঘটনা প্রবাল প্রাচীরের ধ্বংস এবং মাছের ব্যাপক মৃত্যু ঘটায়তবে উষ্ণায়নের জলবায়ুতে এল নিনোর ভবিষ্যৎ প্রভাব এবং দিক নির্ধারণ করা যায়নি।

তবে উইগনল বলেন২৫২ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর ভৌগোলিক অবস্থান অনেক ভিন্ন ছিল — একটি বিশাল মহাদেশ “ প্যানজিয়া”  এবং একটি বিশাল মহাসাগর ছিলযা হয়তো এটিকে আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তুলেছিল।

তিনি বলেন, “পার্মিয়ান যুগের শেষের সময়টি পৃথিবীর জীবনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংকট ছিলকিন্তু আমি মনে করি না আমরা কখনো সেই পরিস্থিতির কাছাকাছি যাব। কারণ তখন পৃথিবী ছিল এক অদ্ভুত গ্রহযেখানে একপাশে একটি মহাদেশ এবং অন্যপাশে বিশাল একটি মহাসাগর ছিল।”“তখন পৃথিবী খুবই দুর্বল অবস্থায় ছিল।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024