বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো জেলায় ২৪ ঘণ্টায় চতুর্থ সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করা হয়েছে কক্সবাজারে। বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটা থেকে শুক্রবার বিকেলে তিনটা পর্যন্ত জেলাটিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫০১ মিলিমিটার।
অতিবৃষ্টি ও ঢলের কারণে পাহাড় ধসে দুই উপজেলায় মারা গেছেন ছয়জন।
জেলার কয়েকটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল ছাপিয়ে প্লাবিত হয়েছে কক্সবাজার শহরও। অনেক জায়গাতে রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে, লঘুচাপের প্রভাবে ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
কক্সবাজারে পাহাড় ধসের ঘটনা দুটি ঘটেছে সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়ন ও উখিয়া উপজেলার হাকিমপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে জানান, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বৃষ্টির কারণে ঝিলংজা ইউনিয়নে পাহাড় ধসে মা ও দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটেছে।
তারা হলেন আঁখি মনি এবং তার দুই মেয়ে মিহা জান্নাত নাঈমা ও লতিফা ইসলাম। আঁখি মনির স্বামী মিজানুর রহমান এ ঘটনায় আহত হয়েছেন।
ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে বাসিন্দাদের অনেককে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। নিহতদের পরিবারকে সহায়তা এবং আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেয়ার কথাও জানান মিজ চৌধুরী।
দুইদিনের ভারী বর্ষণের সাথে সাথে ফ্ল্যাশ ফ্লাড দেখা দেয় উখিয়ার হাকিম পাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
“এতে বিভিন্ন স্থানে মাটি সরে গিয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে এলাকাগুলো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কক্সবাজার ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ দৌজা।
রাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে তিনটি ঘর বিধ্বস্ত হয় বলে বিবিসি বাংলাকে জানান স্থানীয় সাংবাদিক এহসান আল কুতুবী।
এ ঘটনায় মৃত্যু হয় বাবা ও দুই সন্তানের। তারা হলেন আবদুর রহিম, আবদুল হাফেজ এবং আবদুল ওয়াহেদ।
শামসুদ দৌজা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়া হলেও অনেকে আবার সেখানে ফিরে যাচ্ছেন।
পাহাড় ধসের ঘটনায় একজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপ শুক্রবার সকালে সুস্পষ্ট লঘুচাপে রূপ নেয়। বিকেল নাগাদ সুস্পষ্ট লঘুচাপটি নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বুলেটিনে জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা এবং পায়রা বন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে।
উপকূলবর্তী জেলা কক্সবাজারে গত বুধবার রাত থেকে মাঝারি থেকে কখনো কখনো ভারী বর্ষণ চলমান।
সেখানে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ জেলাভিত্তিক বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিপ্তর।
অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, কেবল বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটা থেকে শুক্রবার বিকেল তিনটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে তারা।
কক্সবাজারের জন্য একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড এটি।
এর আগে, ২০১৫ সালে ৪৬৭ মি.মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল সর্বদক্ষিণের জেলাটিতে।
২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ডটি ১৯৮১ সালের। ওই বছরের ১৮ই জুলাই নোয়াখালীতে ৫২০ মি.মি. বৃষ্টিপাতের হিসাব জানাচ্ছে আবহাওয়া দপ্তর।
১৯৭৬ সালের সাতই সেপ্টেম্বর তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার শ্রীমঙ্গলে ৫১৮ মি. মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল।
আর, ১৯৮৩ সালের চৌঠা অগাস্ট চট্টগ্রামে ৫১১ মি.মি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
পাহাড় ধসে দুই স্থানে মোট ছয়জন মারা গেছেন
ভারী বর্ষণে কক্সবাজারের নয় উপজেলার বেশিরভাগ নিম্নাঞ্চলে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। জেলাশহরের সড়কগুলোর কোথাও কোথাও হাঁটুপানি।
অতিবৃষ্টির সঙ্গে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলে প্লাবিত হয়েছে অনেক বাড়ি ঘর।
এতে স্থানীয় জনজীবনে যেমন দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে, বিপাকে পড়েছেন পর্যটকরাও।
প্রসেনজিৎ রায় নামে এক পর্যটক বিবিসি বাংলাকে জানান, তিনদিনের ভ্রমণের দু’দিনই হোটেলে বন্দি থাকতে হয়েছে তাদের।
“হোটেলের সামনের সড়কেও পানি উঠে গেছে, বৃষ্টির ঝাপটায় দরজা-জানালাও খোলা যাচ্ছে না,” বলছিলেন মি. রায়।
আবাসিক হোটেল-মোটেলের জন্য পরিচিত কলাতলী এলাকার পথঘাট ডুবে থাকায় সব পর্যটকই এক রকম আটকা পড়েছেন।
তবে, ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক আছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে সৈকতে লাল পতাকা দিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে যেন পর্যটকরা সাগরে না নামেন।
কক্সবাজার শহরের রাস্তাঘাট ডুবে গেছে
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে মৌসুমী বন্যা এবং বৃষ্টিপাত সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য জানানো হয়েছে শুক্রবার সকাল ১১টায়।
বলা হয়েছে, “চট্টগ্রাম বিভাগের মুহুরী, ফেনী ও গোমতী নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, অপরদিকে হালদা, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
আবহাওয়ার পূর্বাভাসের বরাত দিয়ে বলা হয়, দেশে এবং উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতার প্রেক্ষিতে, আগামী দুইদিন চট্টগ্রাম বিভাগের নদীসমূহের পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
এর ফলে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর জেলার কিছু কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র।
তবে, জোরালো বন্যার শঙ্কা কম উল্লেখ করে সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, বন্যা হলেও স্বল্পমেয়াদী হবে।
অর্থাৎ, এর স্থায়িত্ব দুই তিনদিনের বেশি হবে না।
তাছাড়া, প্লাবনের শঙ্কা কক্সবাজার ও বান্দরবানের দিকে যতটা প্রকট ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলে ততটা নয়।
ফেনী-নোয়াখালীর মানুষ এখনো কয়েকদিন আগের ভয়াবহ বন্যার পর পুনর্বাসন পর্যায়ে রয়েছেন।
“এ কারণে আগে থেকেই সেখানকার মানুষকে সতর্কতার আওতায় রাখতে চাই আমরা,” বলেন মি. বড়ুয়া।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানিই এখন বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply