মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
ট্যাবলয়েড পত্রিকা নিয়ে সারা পৃথিবীতে নানা ধরনের কথা প্রচলিত আছে। অনেকে বলেন ট্যাবলয়েড পত্রিকা বিচিত্র কথার জন্ম দেয়। আসলে ট্যাবলয়েড নিজেই অনেক কথার জন্ম দিয়েছে। ট্যাবলয়েড পত্রিকার সংজ্ঞা খুঁজতে গেলে তাই যে কেউ কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়বেনা
অক্সফোর্ড ডিকশনারি বলছে, ট্যাবলয়েড হলো ছোট আকারের পৃষ্ঠার সংবাদপত্র, সংক্ষিপ্ত সংবাদ ও অনেক ছবি এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নিয়ে কাহিনী যা অনেক সময় কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরে।
লংম্যান ডিকশনারি জানাচ্ছে, ছোট আকারের সংবাদপত্র যা প্রচুর ছবি এবং হালকা চালের খবর দেয় বিশেষ করে উত্তেজক ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নানা গল্প।
শুধু পত্রিকার ক্ষেত্রে নয়, যেসব টিভি চ্যানেলে এই ধরনের অনুষ্ঠান দেখায় তাদের নাম হচ্ছে ট্যাবলয়েড টেলিভিশন। ট্যাবলয়েড সম্পর্কে এমন অনেক নেতিবাচক কথা প্রচলিত থাকলেও বর্তমান বিশ্বে ট্যাবলয়েড পত্রিকা ভিন্ন জায়গা নিয়ে নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে মূল ব্রডশিট পত্রিকার ভবিষ্যৎ পরিণতি হলো ট্যাবলয়েড রূপ ধারণ করা। যা এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে ডিকশনারির সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে!
২.
ট্যাবলয়েড নামের উৎপত্তি খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় বেশ মজার কিছু তথ্য।
১৮৮০ সালে অর্থাৎ প্রায় সোয়াশো বছর আগে লন্ডনভিত্তিক ফার্মাসিউটিকাল কম্পানি বারোজ ওয়েলকাম অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠা করেন দুই আমেরিকান ফার্মাসিস্ট হেনরি ওয়েলকাম এবং সাইলাস বারোজ। কম্পানিটি পরে গ্ল্যাক্সোর সঙ্গে একীভূত হয়। ১৮৮০ দশকের শেষের দিকে এই কম্পানি ট্যাবলেটকে আরো বেশি ঘনীভূত করে বাজারে ছাড়ে যার নাম দেয়া হয় ট্যাবলয়েড। অর্থাৎ মূল ট্যাবলেটের উপকরণ থাকলেও তা আকারে ছোট। এই ব্যবসায় তারা প্রচুর লাভ করে। এরপর থেকে কোনো জিনিসকে সংক্ষিপ্ত বা ছোট আকার করাকে ট্যাবলয়েড নামে ডাকা একটি অভ্যাসে পরিণত হয়। যখন নিয়মিত ব্রডশিটের আকারের বাইরে ছোট আকারে পত্রিকা বের হলো তখন পুরানো কায়দায় এর নাম হলো ট্যাবলয়েড। অন্য সব কিছু থেকে এই নাম দূরীভূত হলেও মিডিয়াতে ট্যাবলয়েড নামটি আসন গেড়ে বসে।
অ্যালফ্রেড হার্মশয়ার্থ ট্যাবলয়েড পত্রিকার জগতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি ছিলেন অসাধারণ ব্যবসায়ী। অচল পত্রিকাকে সচল করায় তার অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি অনেক মৃতপ্রায় পত্রিকাকে কিনে নিয়ে নতুন ভাবে প্রাণ দিয়েছেন। তিনি ট্যাবলয়েড চরিত্রের পত্রিকাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি জানতেন একটি পত্রিকাকে কীভাবে জনপ্রিয় করে তোলা যায়। তিনি তার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এই ব্যবসায় অসামান্য সাফল্য লাভ করেন। পরে দুইজনেই লর্ড উপাধি লাভ করেন। তখন অ্যালফ্রেডের নাম হয় লর্ড নর্থক্লিফ।
শুরুতে অ্যালফ্রেড অ্যানসারস নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এসময় সান্ধ্যকালীন দি ইভনিং নিউজ পত্রিকাটি অর্থ সংকটে ছিল। শোনা যায় তখন এটি বছরে চল্লিশ হাজার পাউন্ড লোকসান গুনতো। ১৮৯৪ সালে অ্যালফ্রেন্ড পত্রিকাটি কিনে নেন পঁচিশ হাজার পাউন্ডে। তিনি একে বিপুল লাভজনক পত্রিকায় পরিণত করেন। ১৯০০ সালের মধ্যে পত্রিকাটি বছরে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড লাভ করা শুরু করে। তার অসাধারণ অরেকটি কাজ হলো দি ডেইলি মেইল পত্রিকার প্রতিষ্ঠা। পত্রিকাটি তখনই সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকায় পরিণত হয়। ১৯১৫ সালে শেল ক্রাইসিংসর সময় এই পত্রিকা সরকার পতনে বড় ভূমিকা রাখে। ডেইলি মেইল এখনো আরেক প্রভাবশালী ট্যাবলয়েড পত্রিকা দি সানের পর বৃটেনে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান ধরে রেখেছে। প্রথমে ব্রডশিটে প্রকাশিত হলেও ডেইলি মেইল পত্রিকাটির ৭৫তম বর্ষপূর্তি থেকে তা ট্যাবলয়েড আকার ধারণ করে।
বৃটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দি টাইমস, দি ইনডিপেন্ডেন্ট, দি স্কটসম্যান সহ অনেক সিরিয়াস পত্রিকা ব্রডশিট আকার ছেড়ে পরবর্তীতে ট্যাবলয়েডে পরিণত হয়।
শুধু বৃটেন নয়, বিশ্বের সিরিয়াস পত্রিকা পাঠকদের কাছে আদূত দি গার্ডিয়ান নিজের আকার ছোট করে নিয়েছে। এতে অবশ্য তার মান ছোট হয়নি! তবে তারা বেছে নিয়েছে ব্রডশিট ও ট্যাবলয়েডের মধ্যবর্তী আরেকটি সাইজ যার নাম বার্লিনার। ইংল্যান্ডে অনেকেই ট্যাবলয়েড শব্দটি ব্যবহার না করে কমপেক্ট বলছে। কারণ তারা ভয় পাচ্ছে ট্যাবলয়েড বললে বিক্রি কমে যেতে পারে।
৩.
ট্যাবলয়েড জার্নালিজম শব্দ দুটো ১৯০১ সাল থেকে পরিচিত হতে থাকে। লন্ডন থেকে এই জার্নালিজম এবং টেবলয়েড সাইজ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যায়।
পত্রিকা প্রকাশের কথার সঙ্গে জার্মানির নামটি এসে যায় কারণ ১৪০০ সালের শেষের দিকে পরিপূর্ণভাবে না হলেও প্যাম্পলেট এবং ব্রডশিট আকারে সেখানে প্রথম পত্রিকা ছাপা হতে থাকে। এসময় প্রকাশিত খবরের মধ্যে যে চরিত্রটি সবচেয়ে আলোচিত হন তার নাম সেপেস
ড্রাকুল। যে চরিত্রকে ভিত্তি করে পরে ব্রাম স্টোকার লিখেছিলেন তার বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ড্রাকুলা।
অর্থাৎ ট্যাবলয়েডে যে ধরনের চমক সৃষ্টিকারী খবর ছাপা হওয়ার কথা বর্ণনা করা হয় সে ধরনের খবরই ব্রডশিট পত্রিকার সূচনার সময় প্রকাশিত হতো। মজার বিষয় হলো এখনো জার্মানিতে একটি পত্রিকা বড় সাইজে প্রকাশিত হলেও ট্যাবলয়েডের চরিত্র ধরে রেখেছে। পত্রিকাটির নাম বিল্ড জেইটুং। পত্রিকাটির সার্কুলেশন চল্লিশ লাখ।
হল্যান্ডে অনেক মূলধারার পত্রিকা ট্যাবলয়েডে প্রকাশিত হচ্ছে। সিরিয়াস পত্রিকা হিসাবে পরিচিত এনআরসি হ্যান্ডেলবাড সম্প্রতি ট্যাবলয়েড আকারে রূপ নিয়েছে। সেখানে মেট্রো- সহ বেশ কয়েকটি ফ্রি ট্যাবলয়েড পত্রিকা বিলি করা হয়।
আমেরিকায় প্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয় বস্টনে ১৬৬০ সালে। পত্রিকার নাম ছিল পাবলিক অকারেন্স। পত্রিকাটি কারা বের করতেন তা জানা যায়নি। পত্রিকাটিতে শাসক বিরোধী লেখা থাকায় নিষিদ্ধ করা হয় এবং সব কপি নষ্ট করার নির্দেশ দেয়া হয়। এমন একটি পত্রিকা যে প্রকাশিত হতো তা পরবর্তী সময়ে বৃটিশ লাইব্রেরিতে রাখা কপি দেখে জানা যায়। ১৭০৪ সালে বস্টন নিউজ লেটার পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা হিসাবে আমেরিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। আমেরিকাতে বৃটেন থেকে ট্যাবলয়েডের ধারণা গেলেও তারা ট্যাবলয়েডকে একটি মর্যাদাবান অবস্থানে নিয়ে যায়। ১৯১৯ সালে আমেরিকায় নিউ ইয়র্ক ডেইলি নিউজ ট্যাবলয়েড হিসাবে প্রথম যাত্রা করে। ১৯২১ সালে পত্রিকাটির প্রথম পাতায় সে সময়ের প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হার্ডিং-এর স্ত্রী আমেরিকার ফার্স্ট লেডি ফ্লোরেন্স হার্ডিং-এর একটি ছবি ছাপে। ছবিটি পুরো পাতা জুড়ে ছাপা হয়। যা তখন অপ্রচলিত ছিল। ফার্স্ট লেডি ফ্লোরেন্স তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কারণে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ছবিটিতে তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। পত্রিকার সেদিনের শিরোনাম ছিল, হার ফাইনেস্ট পিকচার।
8.
বর্তমান বিশ্বে ট্যাবলয়েড পত্রিকা দিয়ে ব্যবসা করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন রুপার্ট মারডক । তার বাবা কিথ মারডক ছিলেন পত্রিকা প্রেমী। বৃটিশ ট্যাবলয়েড লেজেন্ড লর্ড নর্বক্লিফকে তিনি মেন্টর মনে করতেন। রুপার্ট মারডক তার ক্যারিয়ারের শুরুতে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ার পার্থ থেকে প্রকাশিত সানডে টাইমস কিনে নেন। তিনি নর্থক্লিফের টেকনিক ব্যবহার করে ট্যাবলয়েড সানডে টাইমসকে ব্যবসায়িক ভাবে সফল করে তোলেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন পত্রিকা কেনা শুরু করেন। সিডনি থেকে প্রকাশিত সান্ধ্যকালীন ট্যাবলয়েড সানডে মিরর কিনে তিনি সার্কুলেশনের যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারাতে থাকেন। সিডনির আরেক ট্যাবলয়েড দি ডেইলি টেলিগ্রাফ তিনি কিনে নেন স্যার ফ্র্যাঙ্ক প্যাকারের কাছ থেকে। মারডক অস্ট্রেলিয়ার প্রথম জাতীয় দৈনিক দি অস্ট্রেলিয়ান প্রকাশ করেন। নিজ দেশে মিডিয়া সাম্রাজ্য গড়ে তুলে মারডক দেশের বাইরে নজর দেন। পাশের দেশ নিউ জিল্যান্ড দিয়ে তিনি দেশের বাইরের মিডিয়া কেনা শুরু করেন।
এরপর মারডক আসেন বৃটেনে। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত দি সান পত্রিকাটিকে এক সময় তিনি কিনে নেন এবং তাকে ট্যাবলয়েডে রূপান্তরিত করেন। ২০০৬ সালে এসে এর সার্কুলেশন দাঁড়ায় ত্রিশ লাখে। দি সান পত্রিকাটি আধুনিক ট্যাবলয়েড পত্রিকা জগতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে আছে। অনেকে ট্যাবলয়েড বলতে সানকেই বোঝেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে রুপার্ট মারডক তার মিডিয়া সাম্রাজ্য বিস্তারে আরো একধাপ এগিয়ে যান। তিনি লর্ড নর্থক্লিফের দি টাইমস এবং দি সানডে টাইমস কিনে নিয়ে সামাজিকভাবে শক্ত অবস্থানে চলে আসেন এবং বৃটেনের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হন। এরপর তিনি আমেরিকাতে তার ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে প্রথম পর্যায়ে সুপারমার্কেট ট্যাবলয়েড হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন দি স্টার পত্রিকাটিকে। এই স্টার নামে পরে তিনি স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে বিশ্ব সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। আরেকটি প্রভাবশালী ট্যাবলয়েড নিউ ইয়র্ক পোস্ট-এর মালিকও রুপার্ট মারডক। আমেরিকা, ইওরোপ, এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে টিভি, রেডিও, পত্রিকাসহ সব ধরনের মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন মারডক। সারা বিশ্বে তিনি মিডিয়া মুঘল হিসাবে পরিচিত। তার উত্থানের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর প্রবল প্রভাব ও ব্যবসায়িক সফলতা।
৫.
এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ট্যাবলয়েড পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। কাছের দেশ ভারতে প্রথম ট্যাবলয়েড ব্লিৎজ প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। একই গ্রুপের সিনেব্লিৎজ ট্যাবলয়েড সাহসী ছবি ছাপিয়ে আলোচনার ঝড় তোলে। ইংরেজিতে প্রকাশিত শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অফ ইনডিয়া ব্রডশিটে প্রকাশিত হলেও ট্যাবলয়েডের কিছু চরিত্র অনুসরণ করছে। একই গ্রুপের মুম্বাই মিরর ট্যাবলয়েড পত্রিকাটি মুম্বাইয়ের মুভি ইন্ডাস্ট্রিসহ নানা চমকপ্রদ খবর দিয়ে আলোচনার চলে আসে। পাকিস্তানে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে জনপ্রিয় ট্যাবলয়েড পত্রিকার নাম খাবরেইন। সম্প্রতি নয়া আকবর নামে আরেকটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রথম ট্যাবলয়েড পত্রিকা দৈনিক মানবজমিন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
সারা বিশ্ব জুড়ে ট্যাবলয়েড পত্রিকার ধারণা নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা পত্রিকা জগতে বড় আঘাত দিয়েছে। পাশাপাশি অনলাইন পত্রিকার প্রসারে কাগজে প্রকাশিত অনেক পত্রিকার সার্কুলেশন কমে গিয়েছে, অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পত্রিকা প্রকাশের ব্যয় কমানোর জন্য অনেকে ব্রডশিট পত্রিকাকে ট্যাবলয়েডে পরিণত করছেন। পাঠকদের পড়ার সুবিধার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে
একই সঙ্গে। সিরিয়াস পত্রিকাগুলো ট্যাবলয়েড আকারে প্রকাশিত হওয়ায় এই সাইজটিই পাঠকদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠছে। হয়তো এমন একটি সময় আসবে যখন ব্রডশিট পত্রিকা দেখতে লাইব্রেরিতে যেতে হবে।
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক
Leave a Reply