মণীশ রায়
মুকুলকে নিয়ে ওর আব্বা-আম্মা দুজনার দুরকম ধারণা।
ব্যাংকার পিতা আজফার উদ্দিনের চোখে তাঁর একমাত্র ছেলেটির হবার কথা ছিল গর্ব করার মতো তুখোড় মেধাবী এক যুবক, যে কিনা লেখাপড়ায়, খেলাধুলায়, গানে-বাজনায়, ধর্ম-কর্মে, স্বাস্থ্য-সচেতনতায়, আনন্দ-উৎসাহে এবং সর্বোপরি বাস্তবতা-জ্ঞানে অনন্য এক উদাহরণ হবে সমাজে। অথচ মুকুল অলস- অকর্মণ্য প্রকৃতির এক যুবক। ছোটবেলায় সাঁতার শেখেনি ভোরে উঠে মগবাজারের সুইমিংপুলে যেতে হবে ভেবে। ফিনল্যান্ডের একটা ভালো কলেজে স্বল্প খরচে পড়ার সুযোগ মিলেছিল এইচএসসির পর। এক কথায় সে মুখ ফিরিয়ে নিল। যুক্তি দেখালো, সেখানকার ডরমিটরিতে ওকে আফ্রিকানদের সঙ্গে একত্রে থাকতে হবে, সেজন্য।
রাত দেড়টা-দুটোর আগে মুকলের চোখে ঘুম আসে না; আবার সেই ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা বারোটা। আজফার উদ্দিনের মনে হয়, সারাক্ষণ মোবাইল-কম্পিউটার নিয়ে ঘোরের ভেতর ভ্রুণশিশু হয়ে বেঁচে থাকা আধুনিক এক প্রেতাত্মা তাঁর একমাত্র সন্তান। তাকে নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা পিতা কিভাবে বুক ফুলিয়ে বলবে, এটা আমার ছেলে। চেয়ে-চেয়ে দেখো আর ঈর্ষায় ভুগে ভুগে নীরবে মরে যাও?
একমাত্র ছেলে তাঁর, সাধ তো জাগে পুত্রের অর্জনে গদগদ হবার, আবেগাপ্লুত কথার তোড়ে অন্য আব্বাদের বুক লক্ষ্য করে শক্তিশেল মারার, কোন্ পিতা তা না চায়?
অথচ ওর মা নীলুফার এ ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার-উদাসীন। তিনি মনে করেন, ছেলে আমার একদম ঠিকঠাক, লাখে একটা। নম্র, ভদ্র, সভ্য, উদার এবং বিনয়ী। একটুখানি আত্মমগ্ন, তবে তা কিছু না, যুগধর্ম আর বয়সটাই এমনতরো। দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। গাছের মতো, মধু-মক্ষিকার চাকের মতো ওকে ওর মতো করে বাড়তে দাও। শুধু শুধু কেন নিজের ঘুম হারাম করছো অহেতুক চিন্তাগ্রস্ত হয়ে?
কিন্তু এসব কথায় কি আজফার উদ্দিনের হতাশা কাটে? শুরুতে জুনিয়র অফিসার হয়ে তিনি ব্যাংকে যোগ দিয়েছিলেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন তিনি ব্যাংকের ডিএমডি। সেভাবে ছেলের বেলাতেও তিনি আশা করেন, মুকুল তাঁর আকাশ ছোঁবে। সেই লক্ষণ সন্তানের ভেতর খুঁজে না পেয়ে তিনি মনমড়া হয়ে পড়েন। আহত মন নিয়ে কঁকিয়ে ওঠেন, হে মাবুদ, এইডা কি বিচার তোমার!
“ব্যাংক থেকে বাসায় ফিরে ডার্ক চকোলেটের একটা বার ধরিয়ে দিলেন ছেলের হাতে। তারপর বলে উঠলেন ‘তুমি নাকি গাড়ি ছাড়া যেতে চাইছো পুরনো ঢাকায়? কোন কারণ আছে?”
আজফার উদ্দিন ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে অকাতরে টাকাও ঢালতে রাজি রয়েছেন। কিন্তু যার ভরসায় তিনি এগোবেন, সে-ই তো কিছু বুঝতে চায় না। শুধু লতার মতো মায়ের সঙ্গে সব বিষয়ে জড়িয়ে থাকতে চায়। এখনও ছেলের মুখে রাশি-রাশি আদর-সোহাগ মাখানো ভাত তুলে না দিলে সে অভুক্ত থাকে সারাদিন। নীলুফারের আঁচলের তলায় যেন মুকুলের চারণভূমি। যত চেষ্টাই করুক, সেখান থেকে সে বেরুতে নারাজ। অগত্যা কমার্সের একটি সাধারণ বিষয় নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলো তাকে। মুখ আমসি করে আজফার উদ্দিন মন্তব্য ঝাড়েন, ‘মায়ের আশকারায় পোলাটা আমার গেল!’ যেন ছেলেটা আচমকা সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া এক প্রাণ। এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অপার জলরাশির দিকে অসহায় ও দুঃখী দৃষ্টি মেলে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তাঁর!
অথচ ওর মায়ের মন ছেলেকে নিয়ে একেবারে সাদা ফকফকা; মুখে বলেন,’ মিডিওকয়াররাই জীবনে শাইন করে। দেখো। আমার ছেলে ঠিক লাইনেই আছে। ওর এনার্জি বাধা লেখাপড়ার শেখানো বুলির জগতে নয়; অন্য কিছুর জন্য জমিয়ে রাখছে।’ মুখে মিঠা হাসি। যেন মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যত।
আজফার উদ্দিন মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ঠিকই বলে ওঠেন,’ খালি ইমপ্র্যাকটিক্যাল কথার ফুলঝুরি। ছেলেটাও ঠিক মায়ের মতন কোন বাস্তবতা জ্ঞানশূন্য এক-একটি আম্মক!’
পিতা হিসাবে তাঁর চোখ সারাক্ষণ বড়শির মতো ছেলের উপর তাক করা থাকে। ছেলের প্রতিটি কথাবার্তা- হাঁটাচলা তিনি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেন। এ নিয়ে ভাবেন এবং ভাবতে ভাবতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। চোখের সামনে পুত্রের নিঃশব্দ ভাবলেশহীন চেহারাটি অসহ্য মনে হয়। বেত্রাঘাতের মতো তীব্র যন্ত্রণা বোধ করেন নিজের ভেতর।
প্রতিদিন গাড়ি করে কলেজে যায় মুকুল। ক্লাস শেষে ফিরে আসে ইস্কটনের তাঁর কেনা-গড়া মনোরম ফ্ল্যাটটিতে। কোনকিছু জিজ্ঞাসা করলে মুখে কোন সদুত্তর নেই। কোনরকমে হু-হা ধরনের একটা উত্তর দিয়ে মায়ের কাছে ছুটে যেতে পারলেই যেন সে বেঁচে যায়। তখন ওর হয়ে ওর মা কিছু একটা উত্তর দিয়ে দেয়। এভাবে আব্দার করার উর্বর ও স্বস্তিদায়ক জায়গা ওর মা হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়া, পোশাক পরিচ্ছদ, কেনা-কাটা সব ওর মায়ের মাধমে আজফার উদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়। তিনি শুধু টাকা দিয়ে খালাস। অধিকারশূন্য দুর্ভাগা এক পিতা তিনি, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনটাই ছেলের উপর ফলাতে পারেন না। এ কষ্ট অভিমান হয়ে তাঁকে অবিরাম চাবুক মারে, তিনি একাকী বয়ে বেড়ান সে যাতনা।
শরীর খারাপ হলে ছেলের সেবা পাওয়ার খুব ইচ্ছে জাগে তাঁর মনে। রোগ জরজর গলায় ছেলেকে আপ্রাণ ডেকেও কোন লাভ হয় না। কিছুতেই মুকুল তাঁর কাছে ঘেঁষে না। মায়ের অনুমতির জন্য সে বরফের মতো জমে থাকে। যেইমাত্র নীলুফার মুখ ফুটে ‘তোমার আব্বার মাথা টিপে দাও তো আব্বা’ বলবে তখনই সে গলতে শুরু করবে, সচল হয়ে এগিয়ে আসবে ওর দিকে। এজন্য অব্যক্ত ক্ষোভ-অভিমান আর জ্বালায় অবিরাম জ্বলতে শুরু করেন তিনি। তবু সংসারে অশান্তি হবে ভেবে সবকিছু চেপে রাখেন নিজের ভেতর। ছেলেটার ছাগলের মতো অবিরল ম্যা-ম্যা করার বদঅভ্যাসটা ওর মাথায় যেন লাঠি মারতে থাকে; কবে যে মাতৃজঠর ছেড়ে স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব ওর বিকশিত হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই আজফার উদ্দিনের। চোখ বুঝলেই ছেলের ভবিষ্যত ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকতে দেখেন তিনি। ছটফট করেন অজানা শঙ্কায়।
আজফার উদ্দিনের বড় লোভ হয় তাঁর ছেলে ওর সঙ্গে গলায় গলা মিলিয়ে কথা বলুক, আব্দারে-আব্দারে ব্যতিব্যস্ত করে তুলুক ওর ব্যস্ত সময়। এমন কি, হতাশা, যন্ত্রণা কিংবা ব্যথা পেলেও কেবল ওরই কাছে নিজেকে মেলে ধরুক সে। কিন্তু সে একেবারে বিপরীত। ওর একমাত্র শখ বলতে নানা জাতের ক্যাকটাস দিয়ে ফ্ল্যাটের বারান্দা সাজানো। এটা কোন হবি হল?
পাশের ফ্ল্যাটের শুল্ক কর্মকর্তার হাসিখুশি কন্যা রাহা কদিন ক্যাকটাস নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে মুকুে পাশে বসে থাকত। মনে হতো রুমে আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে বাসায় ফিরে আজফার উদ্দিন নীলুফারকে ইশারায় প্রশ্ন করতেন, রাহা এসেছিল?’ মনে হতো, ছেলেটা স্বাভাবিক হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে হয়তো একদিন মায়ের সঙ্গে অহেতুক জুড়ে থাকার অতি বাইটুকু ছিন্ন করে বাস্তব পৃথিবীর দিকে মুখ তুলে তাকাতে শিখবে তাঁর ছেলে। তাই বারবার করে একই প্রশ্ন করে নীলুফারকে।
‘তাতে তোমার কি?’ মুচকি হাসে নীলুফার। ভার্সিটি জীবনের গভীর প্রেমের পর ওদের বিয়ে হয়েছিল। তাই খুনসুটির সুর ওর গলায়।
‘আরে বাবা, আমার পোলা না? প্রেমে পড়ে যদি ছেলেটা একটু সাবলীল হয়। একটুখানি যদি বাস্তবে ফিরে আসে!’
কিন্তু কদিন বাদে আজফার উদ্দিন দেখলেন, রাহা আর ওদের ফ্ল্যাটে আসে না। খোঁজ নিতেই নীলুফার জানালেন, দুজনার ভেতর বেদম ঝগড়া বেঁধেছে। মেয়েটি ওর কোন একটা ক্যকটাসের গায়ে নখ বসিয়ে দিয়েছিল। তাতেই মুকুল ক্ষেপে আগুন। যাচ্ছে-তাই বলে ওকে তাড়িয়ে দেয়। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।
সব শুনে আজফার উদ্দিন মন্তব্য করলেন,’ খুনি একটা।’
‘তুমিও কম কর নাই। চেইতা একবার আমার হাত মচকে দিছিলা বোটানিক্যাল গার্ডেনে। মনে আছে?’
তিনি আর কথা বলেন না। নিজের রুমে গিয়ে ল্যাপটপ ছেড়ে নেটফ্লিক্সে ছবি দেখতে শুরু করে দেন। কিন্তু মন থেকে বিষণ্ণতার মেঘ আর কাটে না।
কদিন বাদে নীলুফার এসে জানালেন,’ মুকুল তোমার গাড়ি নিয়ে কলেজে যেতে রাজি নয়।’
সব শুনে আজফার উদ্দিন একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, তাহলে ও যাবে কি করে?’
‘ওকে জিজ্ঞাসা কর? সব আমার কাছ থেকে জানতে চাও কেন?’ মুখঝামটা দেন নীলুফার।
অফিসে কাজের ফাঁকে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দেন তিনি। কিন্তু কোন কুল-কিনারা খুঁজে পান না। ছেলেটার মতিগতি কোন দিকে যাচ্ছে তা যেন তাঁর বোধ-বুদ্ধির বাইরে চলে যাচ্ছে।
ব্যাংক থেকে বাসায় ফিরে ডার্ক চকোলেটের একটা বার ধরিয়ে দিলেন ছেলের হাতে। তারপর বলে উঠলেন ‘তুমি নাকি গাড়ি ছাড়া যেতে চাইছো পুরনো ঢাকায়? কোন কারণ আছে?’
মুকুলের মাথা নিচু; কণ্ঠ শান্ত। একটু বাদে উত্তর দিয়ে চমকে দিল আজফার উদ্দিনকে, ‘কলেজে নিরানব্বই ভাগ ছাত্র যাচ্ছে গাড়ি ছাড়া। বেশিরভাগই বাসে-রিক্সায়-স্কুটারে করে কলেজে ক্লাস করতে আসে। আমি এমব্যারাস্ড ফিল করি তাতে।’ আর কোন কথা নয়, চুপ হয়ে গেল মুকুল।
উত্তর পেয়ে হতবাক আজফার উদ্দিন। এদ্দিন ওর ধারণা ছিল, ছেলে জগৎ-সংসারের কোন খবর রাখে না, কিছুই বোঝে না, একেবারে নাদান বাচ্চা সে। কিন্তু ছেলের মুখ থেকে এ উত্তর পেয়ে তাঁর সব ভুল ভেঙে গেল। ছেলের বয়সে ওর কত সাধ ছিল বাটা থেকে একটা নর্থস্টার সু কিনে পায়ে দেবার। শিক্ষক পিতার পাঁচ ভাইবোনের একজন সে, টাকার অভাবে সে তা কিনে পায়ে দিতে পারেনি। একটা রিবন সানগ্লাস চোখে দেবার সে কি উদগ্র আকাঙ্ক্ষা ছিল ওর মনে। লি জিন্স আর এডিটাস টি-শার্ট গায়ে দিয়ে চোখে সেই রিবন সানগ্লাস লাগিয়ে মেয়েদের হলের সামনে নায়কদের মতো ঘোরাঘুরির খুব শখ ছিল ছাত্র বয়সে। কিছুই কি ওই বয়সে পূর্ণ হয়েছে? অথচ ওর ছেলেটা হাতের মুঠোয় সব পেয়েও কিভাবে সেগুলো অস্বীকার করে? এ শক্তি সে পায় কোথায়?
সব মিলিয়ে আজফার উদ্দিনের মনে হতাশার পাশাপাশি একরকম সন্দেহও জাগে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে খবর নেবার জন্য লোক লাগিয়ে দেন। দুদিনেই সব পরিস্কার হয়ে গেল। মুকুল সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দিয়েছে। ওদের পাঠচক্র চলে নিয়মিত। নির্দিষ্ট কিছু বই পড়তে দেয় ওদের গুরুকুল। সাধারণ জামাকাপড় আর সস্তা চটি পরে ঘুরে বেড়ায় মুকুল। চে গুয়েভারা, মার্কস-এঙ্গেলস নিয়ে পড়ে থাকে। বুর্জোয়া সমাজের দমন-পীড়ন শোসন-শাসন নিয়ে সারাক্ষণ মুখর সে। রেডিওর মতো নব ঘুরালেই হল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে থাকবে নির্দিষ্ট এই মুকুল এফ এম ব্যান্ড। মাকেই হজম করতে হয় এসব। যে ছেলেটির মুখ দিয়ে একসময় সারাদিনে চারটি বাক্য বেরোত না, সে এখন কথার ফোয়ারায় ভাসায় অন্যকে। নীলুফারের মন্দ লাগে না। তবু তো ছেলেটা মুখ বন্ধ না করে কথা বলছে ওর সঙ্গে। গদগদ হয়ে স্বামীকে বলে,’ ছেলে আমার ঠিক আছে।’
‘ঘোড়ার ডিম ঠিক আছে। প্রতিযোগিতার বাজারে এসব অচল। বুঝবা একদিন।’ এবারও মনে মনেই নিজের ভেতরকার ঝাল ঝাড়ে। বাইরে মুখ বুজে থাকে; একটাও শব্দ মুখ থেকে বেরোয় না।
আজকাল যখন তখন গরিব বস্তিবাসী ও শ্রমজীবীদের জন্য মুকুল মমতা ঝরায়। সামাজিক বৈষম্য নিয়ে মাথা ঘামায়। সুযোগ পেলে বুঝবার চেষ্টা করে ড্রাইভার পিয়ন আর কাজের বুয়ার অবস্থান। এভাবেই মুকুল ওর পিতার চোখের সামনে ভিন্ন এক মানুষে রূপান্তরিত হতে শুরু করে দেয়।
আজফার উদ্দিনের কপালে কুঞ্চন দেখা দেয়। একমাত্র ছেলে কি সত্যি সত্যি হাতের বাইলে চলে গেল? আজফার উদ্দিনের মন হু হু করে ওঠে একথা ভেবে।
“যুবতী মুক্তির সোপানতল থেকে বেরিয়ে নিমেষে সেঁধিয়ে গেল স্বপ্ন-সৌরভে ভরা দাম্পত্যের এক মনোরম বদ্ধ খাঁচায় এবং বাধ্য গৃহবধু হয়ে কাটিয়ে দিল অনেকখানি সময়”
কদিন আগে ঢাকা শহরে কোন এক এলাকার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সঙ্গে সঙ্গে ওদের সংগঠন প্রতিবাদ করে উঠল। নিজেরা সারারাত গাছতলায় জেগে-বসে গান গাইল। এক-একজন গাছ সেজে ফরিয়াদ করতে লাগল, আমাদের বাঁচান। আমরা বাঁচলে তোমরাও বেঁচে থাকবে। প্লিজ বাঁচান।
ওরা নিজেরা পথ-নাটক করে। রিক্সাওলা-ঠ্যালাওলা হাঁ করে তাকিয়ে ওদের বিনা পয়সার রঙ্গ দেখে। মাঝে মাঝে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ জাতীয় শ্লোগান দিয়ে রক্ত গরম করে। ওরাও সমবেতভাবে কণ্ঠ মেলায়, ‘এক হও।’
একমাত্র ছেলের কথা ভেবে আজফার উদ্দিন রাতে ঘুমাতে পারেন না। নীলুফারকে জানান, কি ভাবলাম আর কি হচ্ছে! ভেবেছিলাম মুকুলটা কানাডায় গিয়ে ওর আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিটা নেবে। এখন দেখছি গাছ সেজে প্রকৃতি বাঁচাতে চাইছে।’
নীলুফার হাসে। ওর মুখের হাসি দেখে আজফারউদ্দিন বিরক্ত বোধ করেন। মুখে বলেন, হাসনের কি অইলো? পোলার ভবিষ্যৎ ধ্বংস হইয়া যাইতাছে আর তুমি হাসতাছো? তোমার লাইগ্যাই পোলাডার এই অবস্থা আজ। তুমিই যত নষ্টের গোড়া।’ বলতে বলতে ওর ফর্সা চেহারা লাল হয়ে যায়। সামান্য বিরক্তবোধ তীব্র ক্ষোভে রূপান্তর ঘটে।
নীলুফার এসবে অভ্যস্ত। তিনি কোন উত্তর দেন না। এমনিতেও কম কথা বলা মানুষ তিনি। স্বামীর স্বভাব ওর জানা। সারাদিনের পর বিছানায় এলে নীরবে শুনে যেতে হয় তাঁর যত অভিযোগ-অনুযোগ আর আক্ষেপের অনর্গল কাঁদুনি। তাই কথা না বাড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন নীলুফার।
এসময় মেঘাচ্ছন্ন আকাশে চাঁদের ম্লান আলোর মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক হাসিখুশি প্রাণবন্ত যুবতীর চেহারা। মেয়েটিকে এককালে খুব চিনত নীলুফার। বিকাল হলেই রোকেয়া হল ছেড়ে ছুটে যেতো টিএসসির দিকে। কী যে এক তীব্র ভালো লাগা ছড়িয়ে থাকতো মুখেচোখে! ওরা আট-দশজন ছেলে-মেয়ে। রাতুল ভাইকে ঘিরে গোল হয়ে বসে বৃন্দ আবৃত্তিতে মেতে ওঠতো সবাই, ‘আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি। তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল / তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।’ কবিতা আওড়াতে আওড়াতে ওরা চলে যেত অন্য কোন জগতে। কিছুতেই সে ঘোর কাটতে চাইত না। রাতুল ভাই ছিল সবার আদর্শ। ভার্সিটির উদীয়মান নেতা এবং শক্তিশালী এক আবৃত্তিকার। গায়ের রং শ্যামলা, মাথা ভরা কোঁকড়া চুল আর লম্বা একহারা গড়ন। যুবতীর চোখে দেখা সবচাইতে বলিষ্ঠ সংবেদনশীল পুরুষ। তিনি যা বলতেন তা-ই মেয়েটির কাছে নতুন বলে মনে হতো। কত মিছিল-মিটিং আর প্রতিবাদ সভায় গেছে সে, সবার সঙ্গে তোজোদীপ্ত গলায় কত যে আবৃত্তি করে বেড়িয়েছে, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট রক্তজমাট শিকলপুজোর পাষাণবেদী..’
সেই রাতুলভাই কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন বিদেশে চলে গেলেন। সবাই বলল তাঁর উপর প্রাণনাশের হুমকি রয়েছে। তাই রাতারাতি তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। দুর্মুখেরা জানাল, তিনি ভণ্ড আত্মপ্রবঞ্চক। সবাইকে ভাসিয়ে তিনি পালিয়েছেন।
যুবতীর সঙ্গে এ জীবনে আর কোনদিন তাঁর দেখা হয়নি। তা সত্ত্বেও জীবন থেমে থাকেনি মেয়েটির।
একদিন পরিচয় হল ক্যাম্পাসের হ্যান্ডসাম ব্রিলিয়ান্ট এক যুবকের সঙ্গে। ছেলেটি সবে ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকেছে।
দুদিনের মাথায় ছেলেটি ওকে বলল, ‘বিয়ে করবে আমায়?’
যুবতী মুক্তির সোপানতল থেকে বেরিয়ে নিমেষে সেঁধিয়ে গেল স্বপ্ন-সৌরভে ভরা দাম্পত্যের এক মনোরম বদ্ধ খাঁচায় এবং বাধ্য গৃহবধু হয়ে কাটিয়ে দিল অনেকখানি সময়।
যুবতী ধীরে ধীরে ভুলে গেল ওর জীবনের একদা স্বপ্নপুরুষ রাতুল ভাইকে। ভুলে গেল নিজের প্রতিবাদী অতীতকে, ওর দ্রোহী সত্তাকে।
বহুদিন পর আবার সব মনে হচ্ছে।
তাহলে মুকুল কি এককালের স্বপ্নপাগল দ্রোহী যুবতীরই প্রতিচ্ছবি?
এসময় নীলুফারের পাতলা ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে উষ্ণ রহস্যময় হাসি খেলে যায়।
Leave a Reply