পিওতর মান্তেইফেল
ঈগলের শিকার
সূর্য ঢলেছে অন্তাচলে। ন্তেপে এক হপ্তা কাজের পর আমি সেমিপালাতিনকে ফিরছি একমাত্র মেঠো পথটা দিয়ে। অন্ধকার নেমে আসছে, অথচ শহর এখনো দূরে। হঠাৎ পাহাড়তলির পেছনে দেখা গেল কাজাখদের একটা ছাউনি। দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিল গৃহস্বামী, আমায় দেখে অমায়িকভাবে সে হাসলে। নমস্কার বিনিময় করলাম আমরা। জিরিয়ে নেবার জন্যে সে আমন্ত্রণ জানাল আমায়। ছাউনির কোণে একটা খোঁটায় বসে ছিল বিশাল এক বেরকুট ঈগল। তার নিশ্চলতা বিভ্রান্তিকর; মনে হতে পারত বুঝি ওটা স্টাফ-করা পাখি।
‘অন্ধকারে ও বসে আছে যে?’ জিজ্ঞেস করলাম গৃহস্বামীকে। ‘এতে যে ওড়াই ভুলে যাবে।’
পাখির মালিক মুচকে হাসল। পাখিটাকে বাইরে এনে সে তার মাথা থেকে টুপি খুলে ছেড়ে দিল। প্রকান্ড শিকারী পাখিটা তার বিশাল ডানা নেড়ে পাক দিতে লাগল ছাউনির ওপরে। ক্রমে ক্রমে খুব উচুতে উঠে গেল ঈগলটা, মনে হল আর ফিরবে না। কিন্তু তার মালিক জোরে হাঁক দিতেই ঈগল ডানা গুটিয়ে পাথরের মতো পড়তে লাগল আমাদের পায়ের দিকে। একেবারে মাটির কাছাকাছি এসেই সে তার ডানা মেলে হালকাভাবে মাটি ছলে। আগের জায়গায় তাকে নিয়ে গিয়ে পুরস্কার হিশেবে দেওয়া হল বড়ো একখণ্ড মাংস।
পালকওয়ালা বন্ধুর গায়ে আদর করে হাত বুলিয়ে গৃহস্বামী বললে, ‘খাশা শিকারী। তুষার পাত শুরু হচ্ছে। যদি চাও তো কাল প্রথম তুষার পাতে চলো, একসঙ্গে যাই শিকারে।’
আমি রাজী হলাম। সকালে রওনা দিলাম ঘোড়ায় চেপে। কাজাখটির হাত ছিল একটা বিশেষ ঠেকার ওপর, চামড়ার দস্তানায় ঢাকা। ঈগলটা তার ওপর বসে ছিল নিশ্চল হয়ে। একটা নীরন্দ্র টুপিতে তার মাথাটা পুরো আঁটা।
শিগগিরই নেকড়ের পায়ের চিহ্ন চোখে পড়ল, আর গোটা দশ কিলোমিটার পরে দিগন্তে দেখা গেল নেকড়েকেই। ঈগলের মাথা থেকে টুপি খুলে নিল শিকারী, বিরাট পাখিটা উড়ে গেল আকাশে।
কয়েকবার পাক দিয়ে ঈগলের নজরে পড়ল তার শিকার, একেবারে হিশেব করে সে পেছু নিলে। উড়তে লাগল শোঁ শোঁ করে, ঈগল আর নেকড়ের মধ্যে ব্যবধান দ্রুত কমতে লাগল। প্রাণপণে ঘোড়া ছোটালাম আমরা। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই নেকড়ে আর তার ডানাওয়ালা পশ্চাদ্ধাবক হারিয়ে গেল পাহাড়তলির আড়ালে।
অকুস্থলে যখন পৌঁছলাম, তখন পাখি আর জানোয়ারের দ্বন্দ্বযুদ্ধে শিকারীর হস্তক্ষেপ প্রায় অনাবশ্যক। এক পায়ে ঈগল পাখিটা তার শিকারের উরুতে নখ বি’ধিয়ে অন্য পায়ে উল্টে ফেলা নেকড়ের মুখটা চেপে ধরেছে। পাখি তাকে এত জোরে ঠেসে ধরেছে যে সিধে হতে দিচ্ছিল না। কাঁচা চামড়ার বেল্টে পাখির পা বেশ শক্ত করে গাঁথা। এই সাবধানতাটুকু অনাবশ্যক নয়: নইলে জোরদার নেকড়ে সিধে হবার চেষ্টায় ঝাঁকুনি দিতে গিয়ে ঈগলের ঠ্যাঙ ভেঙে ফেলতে পারত।
লড়াই শেষ হয়ে আসছিল। শিকারী ঈগলের কাছে গিয়ে চট করে তার আলখাল্লা ছড়ে দিলে তার ওপর, আর আলখাল্লার তলে খপ করে টুপি পরিয়ে দিল তার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গেই নরম আর শান্ত হয়ে এল পাখিটা।
বলাই বাহুল্য, নেকড়েকে ঘায়েল করা ঈগলের পক্ষে সহজ নয়। সেইজন্যেই শিকারী আরো বেশি ভালোবাসে আর কদর করে তার দুঃসাহসী পাখিটাকে, যা শরতে তার জন্যে শিকার করে দেয় বহু খরগোস, শেয়াল এবং আরো নানা ফারওয়ালা জম্বু।
Leave a Reply