গুপ্ত আশ্রয় থেকে খরগোস লাফিয়ে বেরলে শেয়াল তার পেছু ধাওয়া করল শতখানেক মিটার। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তার পাল্লা ধরতে না পারলে সে খরগোসকে ছেড়ে দিয়ে ইঁদুর শিকার চালিয়ে যায়। সাধারণত অনিশ্চিত শিকারের পেছু নিয়ে অযথা শক্তিক্ষয় করে না হিংস্র জন্তুরা। একবার লাফ দিয়ে ফসকে গেলে বনবিড়ালও আর খরগোসের পেছ নেয় না।
অথচ লোকের ধারণা হিংস্র জন্তুর হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় কেবল দৌড়ে ছুটে। এটা সত্যি নয়, যদিও ক্ষিপ্রতারও যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।
ইউক্রেনের স্তেপে একবার দেখেছিলাম, খরগোসরা খাচ্ছে, আর একটা শেয়াল তাদের ঘিরে পাক দিতে দিতে ক্রমাগত কাছিয়ে আসছে, কিন্তু পাক-খাওয়া মূর্তিটায় ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করছে না খরগোসগুলো।
মস্কোর ফার ইনস্টিটিউটের জীব-টেকনোলজি বিভাগের স্নাতকোত্তর গবেষক ম. প. পাভলভ ক্রিমিয়ার প্রাণীদের জৈবিক বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করছিলেন। একবার তিনি পাহাড়ের গাছপালাভরা ঢালু দিয়ে যাচ্ছিলেন। তৃণক্ষেত্রে তাঁর চোখে পড়ল একটা শেয়াল, তার কিছু দূরে নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে একটা খরগোস। গাছের সঙ্গে সে’টে থেকে তিনি লক্ষ্য করলেন যে শেয়ালটা যেন খরগোসকে দেখে নি এমনি ভাব করে যখন তার কাছ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন খরগোসটা মাত্র খানিকটা ছুটে গিয়ে ফের তার খাওয়া চালাচ্ছিল।
এইভাবেই চলল অনেকখন।
শেষে বাতাসে পাডলভের’ ওভারকোটের ঝুলের দিকটা দুলে উঠল। সেটা খরগোসের চোখে পড়তেই এক লাফে সে লুকিয়ে গেল ঢালুর আড়ালে। শেয়াল সেটা লক্ষ্য করে নি, তখন সে তাকিয়ে ছিল উল্টো দিকে। তারপর যখন সে খরগোসকে আর স্বস্থানে দেখল না, তখন চঞ্চল হয়ে উঠল শেয়ালটা, গন্ধ শুঁকতে লাগল তার চিহ্নের, তারপর লাফাতে লাফাতে তার পেছু নিল।
ম. প. পাভলভ যদি খরগোসটাকে ভয় না পাওয়াতেন, তাহলে ৫-১০ মিনিটের মধ্যেই সে পড়ত শেয়ালের কামড়ে, খরগোসের পক্ষে আচমকা কয়েকটা লাফেই শেয়াল ঘায়েল করত তাকে।
একবার কালিনিন অঞ্চলে সঙ্গিনী ডাকার ডাক দিচ্ছিল একটা তিতির। চোখে পড়ল যে খানা বেয়ে তার দিকে এগুচ্ছে একটা শেয়াল। তিতিরটা তা লক্ষ্য করে খানিকটা ছুটে গেল, কিন্তু তার বাসন্তী ডাক থামাল না। শেয়াল তখন উঠে এসে, তিতিরের চোখের সামনে খানিক গড়াগড়ি করে চলে গেল মাঠে; তারপর তিতিরের দিকে মুখ না ফিরিয়েই আন্তে আন্তে কাছিয়ে আসতে লাগল। তিতির তার ডাক চালিয়ে যায়, তবে প্রয়োজনীয় দূরত্বটা বজায় রাখে পিছিয়ে গিয়ে।
শেয়াল থেমে গেল তখন, মহড়া নেওয়া ছেড়ে দিয়ে ডোবা থেকে খানিক জল খেয়ে চলে গেল আরেক দিকে, অন্য একটা তিতিরের শব্দ আসছিল সেখান থেকে।
পিতৃভূমির যুদ্ধে নিহত জীববিদ আন্দ্রেই পনোমারিয়োভের কাছ থেকে শুনেছি, ভূতপূর্ব ল্যাপ্ল্যান্ড সংরক্ষিত জীবাঞ্চলে চুনা নদীর বরফের ওপর উঠে দেখেন এক জায়গায় বরফে ঢাকা না পড়া খানিকটা খোলা জল রয়েছে, তার কাছেই ডাঙায়
গ্লাটনজাতীয় নেউল আর শেয়ালের পায়ের দাগ।
চিহ্ন দেখে বোঝা গেল দুটো জন্তুই জায়গাটার দিকে এগোয় বিভিন্ন দিক থেকে এবং ক্রমশ পরস্পর কাছিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত গ্লাটন সুযোগ পাওয়া মাত্র শেয়ালের মাথা কামড়ে তার পুঁটি চিপে মারে। তার পায়ের চিহ্নের এক ধার দিয়ে ছে’চড়ে গিয়েছিল তার শিকার, স্কী করে জন্তুটার পেছু ধরতে লেগেছিল অনেকখন। শেষ পর্যন্ত তিনি দেখতে পান বরফের ওপর রক্তাক্ত শেয়ালটাকে। বড়ো আকারের মর্দা সেটা।
ককেশাসের সংরক্ষিত জীবাঞ্চলে অনেকবার দেখা গেছে যে কোনো কোনো নেকড়ে পাহাড়ে ছাগলদের পালের কাছাকাছি থাকে, তাদের মেরে খায়। জন্তুটাকে প্রায় দেখতে পায় ছাগলরা, এমনকি তাদের চোখের সামনেই তা ঘুমোয়। এতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তারা।
ছাগল দেখা মাত্রই নেকড়ে তাদের তাড়া করে না, প্রায় খাড়াই পাহাড় বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যাবার যে সামর্থ্য আছে ছাগলের, নেকড়ে যেন তা হিশেবে রাখে। উপযুক্ত সুযোগ পর্যন্ত অপেক্ষা করে নেকড়ে, তারপর শিকার ধরে বিশেষ শক্তিবায় না করে।
নেকড়ে সবচেয়ে বিপজ্জনক বাচ্চাদের পক্ষে, এদের শতকরা ৫০ ভাগই মারা পড়ে নেকড়ের হামলায়।
তবে শিকার যদি হয় কম ক্ষিপ্র, বা অসুবিধাজনক অবস্থায় থাকে, তাহলে নেকড়েরাও তাড়া করে বই কি। যেমন, ঘন তুষারকণায় ঢাকা জায়গায় খুরওয়ালা দের পা জড়িয়ে যায়, সেখানে নেকড়ে তাদের ওপর আক্রমণ করে, অবাধে ছুটে জম্বুদের
গিয়ে তারা অনায়াসে শিকার ধরে।
স্তেপের দ্রুতগামী হরিণ মাদী, জাইরানের সঙ্গে যদি বাচ্চা-কাচ্চা থাকে, তাহলে তাড়াহুড়ো না করে নেকড়ে তার পেছ নেয়। জীববিদ ম. দ. জুভেরেভ আমায় বলেছিলেন, একবার নেকড়ে দেখেও জাইরান পালায় নি, তার বাচ্চাটা ছিল ঝোপের তলে, তার খানিকটা দূরে সে ঘুরঘুর করে।
এরোপ্লেন থেকে তোলা একটা মজার ফোটো দেখেছিলাম। তাতে ছিল একপাল সাইগাক হরিণ ছুটছে তেমন জোরে নয়, আর পালের ভেতর রয়েছে একটা নেকড়ে। শিকারের ব্যাপারে পাখিরাও তাড়াহুড়ো করে না। যেমন, হাঁসের ছানা দেখে তক্ষুনি ছোঁ মারে না কাক। ভারিক্কী ভাব করে তা ছানার সারির পেছন থেকে
পায়ে পায়ে এগোয়। তারপর হাঁস আর ছানারা যখন তার দিকে আর মন দেয় না, তখন সবচেয়ে পেছনকার ছানাটিকে সে ঠোঁটে তুলে নিয়ে উড়ে যায়।
Leave a Reply