হাঁসের খাবার
কী খায় বুনো হাঁসেরা?
মনে হবে তার জবাব এমন আর কঠিন কী। গুলি করে মেরে পেট চিরে দেখলেই হবে কী আছে তাতে।
সাধারণত তা করাও হয়। আর হাঁসের পেটে দেখা যায় ঝিল-জলার হোগলাজাতীয় নানা ধরনের উদ্ভিদের বীজ।
হাঁসেদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্যে লোকে তাই ঝিল-জলায় এইসব গাছ লাগায়। অবশ্য অনেকেই দেখেছে যে বুনো হাঁস মাছ, ব্যাঙ, পোকা-টোকাও ধরে, তবে এটাকে মনে করা হত দৈবাৎ, কেননা তার পাকস্থলীতে লক্ষণীয় মাত্রায় এসব খাদ্যের অবশেষ তো পাওয়া যায় নি।
কিন্তু মস্কো চিড়িয়াখানায় যখন সাইবেরিয়া থেকে বড়ো একঝাঁক বুনো হাঁস এল, তখন একেবারেই ধারণা পালটাতে হল। মস্কোয় পৌঁছবার আগে দেড় মাস তাদের কাটে ঘাঁটিতে আর পথে।
গোটা পথটা তাদের খাওয়ানো হয় কেবল গম আর মাছ। মস্কোয় আমরা মরে যাওয়া কয়েকটা বুনো হাঁসকে ব্যবচ্ছেদ করি। তাদের পেটে পাওয়া যায় কেবল এক ধরনের হোগলার বীজ।
হাঁসেরা তাহলে কি এই বীজ খেয়েই থাকে? পাঁয়তাল্লিশ দিনেও যা হজম হয় নি, সে খাদ্য কার দরকার?
শক্ত এই বাঁজগুলো পাকস্থলীতে থেকে গেছে তা হজম হয় নি বলেই। ছোটো ছোটো কোয়ার্টজ পাথরের সঙ্গে মিলে এই শক্ত বীজগুলো এক ধরনের যাঁতার কাজ করে দ্রুত খাদ্য পিষে ফেলত।
কিন্তু তাহলে কী খায় হাঁসেরা?
চিড়িয়াখানায় আমরা ঠিক করলাম, জলচর পাখির পরিপাক যলে আমিস খাদ্যের অবশেষ কেন থাকে না সেটা আরো যথাযথভাবে পরখ করতে হবে।
বুনো হাঁসকে আমরা নির্দিষ্ট পরিমাণ এক-একটা খাদ্য খাইয়ে কিছুক্ষণ পরে তাদের ব্যবচ্ছেদ করে পাকস্থলী ও নাড়িতে কী আছে তা দেখতে লাগলাম।
প্রথম যে মন্দা হাঁসটাকে আমরা মাছ, কে’চো, শামুক খাইয়েছিলাম, বিশ মিনিট পরে তার পেট কেটে এসবের কোনো চিহ্নই দেখা গেল না। দ্বিতীয় হাঁসটাকে আমরা কাটি খাবার দেবার পনের মিনিট এবং তৃতীয়টাকে দশ মিনিট পরে।
ফলাফলটা দাঁড়াল এই: গৃহীত খাদ্যের কোনো অবশেষই পাওয়া গেল না
পাকস্থলীতে! একটা আঁশও মিলল না, যদিও অন্যান্য পশুর ক্ষেত্রে হলদে পাইক মাছের বড়ো আঁশ হজম হতে সময় লাগে অনেক।
অত তাড়াতাড়ি হজমের আশ্চর্য শক্তি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় হাঁসের খাদ্য বিষয়ে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত টানা হয়েছিল।
অবিশ্যি, হাঁসের খাদ্যে অনেক উদ্ভিদেরই একটা নির্দিষ্ট তাৎপর্য আছে, কিন্তু কেউ যদি বুনো হাঁসকে শুধু জলার উদ্ভিদের শক্ত বাঁজ খাইয়েই রাখতে চায়, তবে অচিরেই তারা মারা পড়বে খিদেয়।
সন্ধ্যায় বুনো হাঁসেরা উড়ে যায় মাঠ বা বনের ফাঁকায়, এবং প্রচুর কে’চো খায় সেখানে, রাত্রির দিকে কে’চোগুলো বেরিয়ে আসে মাটি থেকে।
দু’-তিন মিনিটের মধ্যেই কে’চোগুলো গলে যায় তাদের পাচক রসে, পড়ে থাকে কেবল কে’চোর পেটের ভেতরকার কিছু কালো মাটি।
ছোটো ছোটো কাদাখোঁচা আর দোয়েলজাতীয় পাখির পাকস্থলীও ঠিক এমনি ফাঁকা থাকে। এদের প্রায় সর্বদাই দেখা যায় অগভীর জলের কাছে।
এই এরা জলের দিকে এগোয়, ঢেউ আসতেই আবার পেছিয়ে যায়, মনে হয় যেন নাচছে বালির ওপর। আর ঢেউ ভেঙে পড়ে সরে যেতেই এরা পরের বার ফেনিল ঢেউ আসার আগেই ভেজা বালিতে কীসব খোঁজে।
এদের গুলি করে সঙ্গে সঙ্গেই পেট চিরে দেখেছি আমরা, কিন্তু পাকস্থলীতে পেয়েছি কেবল বালি।
এ আবার কী! বালি খাবার জন্যে তো পাখি আর এখানে আসে নি!
এ প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্যে তরঙ্গভঙ্গের যে ফালিটায় পাখিদের অত আগ্রহ, সেখানকার পলি নিয়ে মিহি চালুনিতে তা ছে’কে দেখে কিশোর জীববিদরা। চালুনিতে পাওয়া যায় অসংখ্য সরু সরু কৃমি।
এই হল তীরে নাচিয়ে কাদাখোঁচা, দোয়েলদের শিকার। দেখা গেল, ঢেউ সরে যেতেই কৃমিরা নড়েচড়ে উঠে পলি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। পরের ঢেউ না আসার আগেই পাখিরা তাদের ধরে ফেলে, আর দু’-তিন মিনিটের মধ্যেই এই কৃমিরা পুরোপুরি গলে যায় তাদের পাকস্থলীতে।
পরে গবেষণা করে দেখা গেল যে সব ধরনের পাখিদের বেলাতেই পরিপাক ক্রিয়া চলে প্রায় একই রকম দ্রুত।
গ্রীষ্মের শেষে বুনো হাঁসরা উড়ে যায় পানা-ঢাকা পুকুরে খাবারের সন্ধানে। প্রশ্ন ওঠে, কেন ঠিক নির্দিষ্ট পুকুরগুলোতেই তারা আসে? কেননা পানা তো থাকে সব পুকুরেই। গুলি করে মারা হাঁস থেকে দেখা গেল এসব জলাশয়ে শুধু এক ধরনের পানাই আছে তাই নয়, প্রজাপতির শুয়োপোকাও আছে প্রচুর। ভাসমান পানার ওপর এই প্রজাপতিরা ডিম পাড়ে। ডিমফুটে শুয়োপোকারা খায় নরম ভাসমান পাতা। পানার সঙ্গে হাঁসেরা এই শুয়োপোকাগুলোকেও গিলে খায়। তবে প্রত্যেক জলাশয়েই এই ধরনের শুয়োপোকা জন্মায় তা নয়, তাই বুনো হাঁসেরা যায় তাদের বাছাই করা জলায়।
Leave a Reply