ডিভিসি থেকে বিপুল পরিমাণ জল ছাড়ায় হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায় চলে গেছে।
গত কয়েক দিনে প্রায় চার লাখ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি)-এর বাঁধগুলি থেকে। তার জেরে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায় চলে গেছে। হঠাৎ করে এতটা জল ছাড়ায় এক লক্ষেরও বেশি মানুষ ভয়ংকর বিপদের মুখে পড়েছেন।
বন্যার জলের তোড়ে বাড়ি ভেঙে গেছে, রাস্তা ভেসে গেছে, রাস্তায় ধস নেমেছে, সবচেয়ে বড় কথা বিভিন্ন জায়গায় গলা সমান জলের মধ্যে তারা নিরাপদ জায়গায় যাচ্ছেন।
পরিস্থিতি উদ্বেগজনক
হুগলি থেকে ডিডাব্লিউ বাংলার সাংবাদিক স্যমন্তক ঘোষ জানাচ্ছেন, ”ডিভিসির পাঞ্চেত ও মাইথন বাঁধ থেকে জল ছাড়ার ফলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে হুগলি ও হাওড়ার। বাঁকুড়া, বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুরের কিছু এলাকাও বন্যার জলের তলায়। ”
স্যমন্তক বলেছেন, ”পরিস্থিতি খুবই খারাপ। পুরশুড়ায় বন্যায় জল সমানে বাড়ছে। সেই জল প্রবল বেগে বয়ে চলেছে। হাওড়া ও হুগলির অনেক জায়গায় রাস্তা ধসে গেছে। বন্যাক্রান্ত মানুষরা জানাচ্ছেন, আগে তারা বুঝতে পারতেন, বন্যা হতে পারে। এবার সেই সংকেতটা তারা পাননি। একরাতের মধ্যে বিপুল জলরাশির তলায় চলে গেছে তাদের ঘরবাড়ি। ”
পুরশুড়ার অবস্থা খুবই খারাপ। সেখানে এনডিআরএফের দুইটি দল উদ্ধারকাজে নেমেছে। এসডিআরএফও উদ্ধারকাজ করছে। খাবার ও পানীয় জলের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে।
ডিভিসি বিপুল পরিমাণ জল ছাড়ায় দামোদর ও মুণ্ডেশ্বরী নদী বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে বইছে। খানাকুল, আরামবাগ, গোঘাট, ঘাটালের অবস্থা বেশ খারাপ। মানুষ উঁচু জায়গায় গিয়ে বসে আছেন। তাদের ঘর ডুবেছে। ত্রাণ পৌঁছাতে যত দেরি হচ্ছে, ততই তাদের ক্ষোভ বাড়ছে।
পুরশুড়ায় বন্যার অবস্থা উদ্বেগজনক।
বন্যা দেখতে গিয়ে নদীতে
বীরভূমের লাভপুরে বন্যা পরিস্থিতি দেখতে গেছিলেন সাংসদ, বিধায়ক, জেলাশাসক-সহ ১৩ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তারা স্পিডবোটে করে লাভপুরের গ্রামগুলিতে বন্যার অবস্থা দেখতে গেছিলেন। স্পিডবোটে ছিলেন সাংসদ সামিরুল ইসলাম, বিধায়ক অসিত মাল ও অভিজিৎ সিং, জেলাশাসক বিধান রায়, পুলিশ সুপার রাজনারায়ণ মুখোপাধ্যায়রা।
হঠাৎ জলের তোড়ে স্পিডবোট উল্টে যায়। তারা জলে পড়ে যান। স্থানীয় মানুষ তাদের উদ্ধার করতে নদীতে নেমে পড়ে। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী চলে আসে। পরে তাদের সবাইকে উদ্ধার করা হয়।
আরো জল ছাড়া হলো
বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার থেকে ৮০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। ফলে দক্ষিণবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যা থেকে ডিভিসি-র জলাধার থেকে জল ছাড়া শুরু হয়। মঙ্গলবার জল ছাড়ার পরিমাণ আরো বাড়ে। বুধবারও এক লাখ কিউসেকের বেশি জল ছাড়া হয়।
মাইথন ও পাঞ্চেতের থেকে ছাড়া জল দামোদর দিয়ে দুর্গাপুর ব্যারেজে পৌঁছায়। সেখান থেকে জল ছাড়া হলে তা যায় রণডিহা ব্যারাজে। তারপর তা নিচের দিকে আসে। সমানে জল ছাড়ার ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায় চলে গেছে।
বিক্ষোভের মুখে মুখ্যমন্ত্রী
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় বুধবার বন্যাদুর্গত এলাকায় গিয়েছিলেন। পুরশুড়ায় শ্রীরামপুর গ্রামের কালীতলায় গাড়ি থেকে নামার পরই মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। একজন বলেন, ”ভোটের সময় শুধু শাসক দলের সাংসদ-বিধায়কদের দেখা যায়।”
এক নারী চেঁচিয়ে বলেন, ‘নেতারা আসলেও ত্রাণ আসছে না। একটা ত্রিপলও তারা পাননি। প্রশাসন অভিযোগ জানানো এক নারীকে আড়াল করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ”আড়াল করলে হবে না। বলতে দিতে হবে।”
এভাবে জল ঠেলে নিরাপদ জায়গায় যাচ্ছেন মানুষ।
মুক্যমন্ত্রী অবশ্য এই ক্ষোভের কোনো জবাব দেননি।
অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ”আমি ডিভিসির সঙ্গে কথা বলেছি। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। এত জল আগে ছাড়া হয়নি। বাংলায় পরিকল্পিতভাবে ‘ম্য়ান মেড’ বন্যা করা হয়েছে। ঝাড়খণ্ডও নিজের রাজ্যকে বাঁচিয়েছে।”
কিন্তু বিরোধী নেতারা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের এই বন্যার জন্য রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা দায়ী।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেছেন, ”এই বার আগে থেকেই প্রবল বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে বলে সতর্কবর্তা দেয়া হয়েছিল। রাজ্য সরকারের যে সতর্কতা থাকা দরকার ছিল, তার লেশমাত্র আমরা দেখিনি। তারা প্রথমদিকে বন্যা পরিস্থিতির উপর কোনো নজর দেয়নি।”
তিনি বলেন, ”পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। আরো বৃষ্টি হলে, সেই জল পশ্চিমবঙ্গ হয়েই যাবে। তাই সরকারকে শুরু থেকেই আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।”
শুভেন্দু অধিকারী সামাজিক মাধ্যমে বলেছেন, ”অপরকে দোষ দেয়া এবং চক্রান্তের কথা বলাটা মুখ্যমন্ত্রীর পুরনো কৌশল। আসল কথা হলো, রাজ্যের সেচ ও জলপথ বিভাগ পুরো ব্যর্থ।”
সিপিএম নেতা নিরাপদ সর্দার জানিয়েছেন, ”ডিভিসির জল ছাড়ার ব্যবস্থাপনায় পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের প্রতিনিধি আছেন। আলোচনাও হয়। রাজ্যের সেচ দপ্তর কী করছিল?”
ডিডাব্লিউডটকম
Leave a Reply