হারেমের ব্যাপার। বাইরে জানাজানি হলে বিপন্ন হবে মান-সম্ভ্রম। তাই আমীর নিজেই তদন্তে বেরিয়েছিলেন।
তদন্ত শেষ করে আমীর মুরাদ বেন-হাম্মাদ আল্-জুলফিকার শিশমহলে এসে দোদুল-কেদারায় বসেছেন। চিন্তা-মেঘাচ্ছন্ন চোখে-মুখে থমথমে ভাব। তিনি ডান পা-টা সামনের তুলতুলে চরণচৌকির ওপর তুলে দেন। সুন্দরী এক বাঁদী ছুটে এসে পা-টা কোলের ওপর নিয়ে টিপতে শুরু করে। আমীর মাথা হেলিয়ে দেন কেদারার গায়ে। ভাবনা-ভারাক্রান্ত মাথা চুলকাতে শুরু করলে আর এক বাঁদী এসে মাথায় হাত বুলাতে লেগে যায়।
-পানি। আমীর হাঁক দেন।
আমীরের মুখের পানি শব্দের অর্থ কি, জানে হারেমের সব বাঁদীই। পানীয়ের ট্রলি সাজানই থাকে। এক বাঁদী সেটাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসে।
-ম্যাডিরা।
-আমীরের মুখে মেহেরবানি হয়েছে আজ। এ মেহেরবানি সব সময়ে হয় না। তখন বাঁদীদের হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। স্থান, কাল আর আমীরের মেজাজ বুঝে পানীয় পরিবেশন করতে হয় তাদের। একটু এদিক-ওদিক হলে শুনতে হয় কলেজে-কাঁপা ধমক। আর যদি ডাহা ভুল করে বসে কেউ, তবে তার রক্ষে নেই। শিশমহল থেকে বদলি করে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হবে বেওয়ামহলে অথবা খারিজামহলের বিষাদপুরীতে।
সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে আমীরের হারেম। মাঝখানে শিশমহল। তার চারদিকে চার বেগমমহল। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে আমীর শরা-শরীয়ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। একই সময়ে চারের অধিক বেগম তিনি রাখেন না। সন্তানবতী বা সন্তানসম্ভবা নারীর দেহ স্পর্শ করা আমীরের পারিবারিক আইনে নিষিদ্ধ। তাই কোন বেগম অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সাথে সাথে বর্জিতা হন। বেগমমহল ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হয় খারিজামহলে। সেখানে তাঁর জন্যে মাসিক খোরপোশের বরাদ্দ হয়। শূন্য বেগমমহলে আসেন নতুন বেগম।
বেগমমহলের চারদিকে অনতিউচ্চ দেয়াল। এ দেয়ালের পেছনে সারি সারি কোঠা বাড়ি। এ বাড়িগুলোর সমষ্টিগত নাম খারিজামহল। খারিজামহলে থাকেন আমীরের পরিত্যক্তা বেগমগণ। এ মহলের বাড়ির সংখ্যা দেড় শ’। কিন্তু তার মধ্যে এখনো বাহাত্তরটি খালি পড়ে আছে।
খারিজা মহলের পেছনে হারেমের প্রধান প্রাচীর ঘেঁষে আছে আরো কতগুলো বাড়ি।
এগুলোর মিলিত নাম বেওয়ামহল। বর্তমান আমীরের ওয়ালেদ মরহুম আমীর হাম্মাদ বেন-জাফর আল-বাবরের উত্তরজীবিনী ছাপ্পান্ন জন বেগম বাস করেন এ মহলে। খারিজামহল থেকে দু’জন আর বেওয়ামহল থেকে একজন বেগম উধাও হয়েছেন। খবর পেয়ে আমীর নিজেই গোপন তদন্তে গিয়েছিলেন। তদন্তে আরো জানা গেছে, তিন জন নপুংসক প্রহরীও হারেম থেকে পালিয়েছে। আমীর বুঝতে পারেন, মোটা বখশীশের লোভেই এরা পথ-প্রদর্শক হিসেবে বেগমদের সঙ্গ নিয়েছে।
ভরা পানপাত্র নিয়ে আসে বাঁদী। আমীরের সামনে সে হাঁটু গেড়ে বসে গালিচার ওপর, পাত্রটা এগিয়ে ধরে তাঁর ঠোঁটের সামনে। আমীর চুমুক দিয়ে দিয়ে পাত্র শেষ করেন। বাঁদী পাত্রে পানীয় ঢালবার জন্যে উঠে যায়। আমীরের মনে চিন্তা ঘুরপাক খেয়ে মরে হারেম থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওরা করবে কি? আবার শাদী করবে? তওবা! তওবা! একদা যারা আমীরের শয্যাসঙ্গিনী ছিল, তারা যাবে আ’ম লোকের শয্যাসঙ্গিনী হতে!
আমীরের সমস্ত শরীর রাগে কাঁপতে থাকে। তিনি উঠে দাঁড়ান। পাশের ঘরে গিয়ে বের করেন কয়েক খণ্ড ফটো-অ্যালবাম। এক টুকরো কাগজে টোকা নাম-পরিচিতির সাথে মিলিয়ে তিনি পলাতকা বেগমদের ফটো যোগাড় করেন। এবার একখণ্ড কাগজ টেনে নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন, ‘খারিজামহলের দু’জন ও বেওয়ামহলের একজন বেগম পালিয়ে গেছে।’ কিন্তু কি মনে করে কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেন। আর একখানা কাগজ টেনে নিয়ে আবার লেখেন, ‘হারেমের তিন জন বাঁদী পালিয়ে গেছে। তাদের ফটো এই সাথে দেয়া গেল। যেখান থেকেই হোক এদের ধরে হাজির করতে হবে। বাঁদীদের সাথে তিনজন হিজড়ে গোলামও রয়েছে।’ চিঠিটা ও তিনখানা ফটো লেফাফার মধ্যে ভরে সীল করিয়ে তিনি ওটা পাঠিয়ে দেন গোয়েন্দা প্রধানের কাছে।
আমীর আবার এসে দোদুল-কেদারায় গা এলিয়ে দেন। পাঁচ গেলাস পানীয় শেষ করেন পর পর। কিন্তু তবুও এ লজ্জাকর ব্যাপারটাকে তিনি মন থেকে আদৌ দূর করতে পারেন না। এক সময়ে তিনি ভাবেন-কিছুদিন আগে বেগমদের খোরপোশ অর্ধেক করার হুকুম দেয়া হয়েছিল। হারেম থেকে পালিয়ে যাবার এটাই কারণ নয় তো?
সাগরের উপকূলবর্তী ক্ষুদ্র দিস্তান রাজ্য। আয়ের শতকরা নব্বই ভাগ ম্যাঙ্গানীজ খনি থেকে আসত। ব্রিটিশ কোম্পানি এ খনিজ পদার্থটির ‘রয়েলিটি’ বাবদ বার্ষিক পঞ্চাশ লক্ষ পাউন্ড তুলে দিত খাজাঞ্চীখানায়। সম্প্রতি দুটো খনি নিঃশেষ হয়ে গেছে। ফলে আয় এখন পঞ্চাশ লক্ষ থেকে তিরিশ লক্ষ পাউন্ডে নেমে এসেছে। আয় কমে যাওয়ার সাথে সাথে ব্যয় সঙ্কোচ করতে হয়েছে অনেক ব্যাপারে। বেগমদের খোরপোশও তাই অর্ধেক করার হুকুম দিয়েছিলেন তিনি।
আমীরের মনের কুণ্ডলায়িত চিন্তা এবার সরীসৃপের মতো এগোতে শুরু করে। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেন, হ্যাঁ, এটাই কারণ। এ ছাড়া আর কিছু নয়।
আমীর উঠে দাঁড়ান। টলতে টলতে চলে যান লিফটের দিকে। কর্তব্যরত লিফটচালক কুর্নিশ করে এক পাশে দাঁড়ায়। আমীর লিফটে চড়ে ছাদে গিয়ে নামেন। সেখানে বিদ্যুৎ-চালিত দড়া-কেদারা প্রস্তুতই ছিল। তিনি ঝুলন্ত দড়া-কেদারায় চড়ে বসেন। দড়াপথ বেয়ে উঁচু দেয়ালের ওপর দিয়ে সেটা চলে যায় শাহী দরবারে। পরামর্শ কক্ষে গিয়ে বসেন আমীর। জরুরী তলব পাঠান উজীরকে।
আমীরের সামনের টেবিলের ওপর কতগুলো বিদেশি সচিত্র সাময়িকী। ছবি দেখে খবর পড়তে তিনি পছন্দ করেন। তাই এ সব বিদেশি পত্র-পত্রিকা তাঁর টেবিলে সাজানই থাকে। একটা টেনে নিয়ে তিনি ছবি দেখতে শুরু করেন।
কারুকার্যখচিত সোনার ট্রেতে করে কতগুলো ভিজিটিং কার্ড এনে সামনে রাখে হুকুমবরদার। আড়চোখে তাকিয়ে ভ্রুকুঞ্চিত করেন আমীর। ওপর থেকে একখানা তুলে নিয়ে দেখেন-আমিরজাদা জোয়াদ বেন মুরাদ।
আমীর মনে মনে বলেন, আমিরজাদা তো বুঝলাম, কিন্তু কোন বেগমের বুঝব কেমন করে? যত সব জঞ্জাল!
তাঁর চোখে মুখে বিরক্তির আভাস। গম্ভীর স্বরে বলেন, নিশান-ই-ফরজন্দ। জন্ম-বিবরণ খোদিত সোনার চাকতি-তারই নাম নিশান-ই-ফরজন্দ।
আমীরজাদারা বাঁ হাতের বাজুতে এবং আমীরজাদীরা কন্ঠে ধারণ করে এ নিশান। যারা বাঁদীর গর্ভজাত তারা পরে রূপোর তৈরি নিশান।
নিশান আনবার জন্যে বেরিয়ে যাচ্ছিল হুকুমবরদার। আমীর কি ভেবে বাধা দিয়ে বলেন, থাক, দরকার নেই। মুনশীকে পয়দায়েশনামা নিয়ে আসতে বলো।
খাসমুনশী পয়দায়েশনামা নিয়ে ছুটে আসে।
ভিজিটিং কার্ডটা খাসমুনশীর দিকে ঠেলে দেন আমীর।
খাসমুনশী পয়দায়েশনামা খুলে বর্ণানুক্রমিক সূচী খুঁজতে থাকে, কিন্তু ঐ নাম খুঁজে
পাওয়া যায় না। আমীর বুঝতে পারেন-জোয়াদ নিশ্চয়ই কোন বাঁদীর ঘরের। আমীর রেগে ওঠেন। ঠোঁট কামড়ে অস্ফুট স্বরে বলেন, হুঁ হ্! বাঁদীর বাচ্চা আমীরজাদা ফুটিয়েছে! হারামজাদার আস্পর্ধা কত!
তাঁর ইচ্ছে হয় ছোকরাকে ডেকে হুঁশিয়ার করে দেন। কিন্তু বাঁদীর বাচ্চার মুখদর্শন অশুভ ভেবে তিনি নিরস্ত হন।
কলমদানি থেকে কলম টেনে নেন আমীর। নামের আগের আমীরজাদা কেটে কার্ডখানা ফেরত পাঠিয়ে দেন-এখন দেখা করবার সময় নেই।
উজীর আসেন। বেগমদের খোরপোশের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা চলে দু’জনের মধ্যে। তাঁদের খোরপোশ পুরো করতে হলে বার্ষিক পঁচিশ লক্ষ খুনার দরকার। দিস্তানি মুদ্রা দশ খুনা এক পাউন্ডের সমান।
আমীর জিজ্ঞেস করেন, আর কোথাও কোন খনি বেরুবার সম্ভাবনা নেই?
-কোন সম্ভাবনা নেই জাহাপনা। ব্রিটিশ আর আমেরিকানরা চষে দেখেছে সারারাজ্য।
“আবার তাঁর মনে হয়-কাজটা যে মহৎ, তা তাঁর কোন মহাশত্রুও অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু হারেমে ঢোকাবার আগে প্রত্যেকটাকে ভালো করে পরীক্ষা করা দরকার ছিল। এর জন্যে দায়ী হারেমের সর্দার দিলবাহার”
তবে উপায়?
উপায় একটা আছে জাহাপনা। সেচ বিভাগটা-
ঠিক, ঠিক। এই তো পাওয়া গেছে। সেচ বিভাগটা তুলে দিন। ওসবের দরকার নেই আর। মরুভূমি বানিয়েছেন আল্লাহ পাক। আল্লাহ পাক যা কিছু করেন ভালোর জন্যেই করেন। তাঁর মর্জির খেলাপ হলে তিনি বেশখ নারাজ হবেন। লোই আলবৎ, জাহাপনা। আল্লার মর্জির খেলাপ এসব সেচ-ফেচ করে গুনাহগার হওয়া উচিত নয় আমাদের।
-এই তো ঠিক বুঝেছেন।
কিন্তু জাহাপনা, সেচ বিভাগটা তুলে দিলে মাত্র পনেরো লক্ষ খুনা বাঁচবে। বাকি দশ লক্ষ?
ইয়ে করুন। কি করতে বলব! হ্যাঁ-হ্যাঁ, ট্যাকস্ বসিয়ে দিন।
ট্যাক্স বসাবার আর কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না, জাহাপনা। সেচ বিভাগের জন্যে মাথা পিছু তিন খুনা করে ট্যাক্স বসানো হয়েছে। এর পরে- ভেবে দেখুন, পথ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
উজীর চিন্তার মধ্যে ডুবে যান। আমীর ‘চিত্রে বিশ্ব-বার্তা’খানার পাতা উল্টিয়ে ছবি দেখতে থাকেন।
উজীরের চিন্তায় বাধা দিয়ে আমীর এক সময়ে বলেন, দেখুন উজীর সায়েব,
নাছারাদের আহাম্মকীর নমুনা দেখুন।
সাময়িকীটা তিনি উজীরের দিকে ঠেলে দেন।
উজীর দেখেন-তুলির যাদুকর মিকায়েল অঙ্কিত জগদ্বিখ্যাত তৈলচিত্র ‘জুলিয়েত’ এর প্রতিলিপি।
আমীর হেসে বলেন, মেয়েমানুষের এ ছবিটা এক ইংরেজ নাছারা কিনেছে চল্লিশ হাজার পাউন্ড দিয়ে। হাঃ হাঃ হাঃ! আরে চল্লিশ হাজার পাউন্ডে মেয়েমানুষের ছবি
কেন? দশ দেশের দশটা জীবন্ত মেয়েমানুষ পাওয়া যায়। অ্যাঁ, কি বলেন?
-আলবৎ, জাহাপনা। ওরা একটার বেশি শাদী করতে পারে না কিনা, তাই। এ এক ধরণের ‘পারভারশান’-বিকৃতি।
-সত্যি, এ এক অদ্ভুত রকমের বিকৃতি। একটু থেমে তিনি বলেন, কই, পেলেন কোন্ পথ? -পথ একটা পেয়েছি, জাহাপনা। এবার খেজুর গাছে ওপর ট্যাক্স বসান যেতে পারে।
আমীরের চিন্তাক্লিষ্ট মুখে হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
তিনি হাত নেড়ে বলেন, ঠিক, ঠিক। আপনি ঠিক পথ পেয়েছেন।
-কিন্তু জাহাপনা, ট্যাক্স আদায় করা বড় মুশকিল হবে। ওরা অত্যন্ত গরীব। -হ্যাঁ, গরীব তো ঠিকই। গরীব বানিয়েছে খোদাওন্দ করিম। মানুষে তার কি
করবে? গরীব বলে কি মালিকের খাজনা দিতে হবে না?
একটু থেমে আবার বলেন, আপনি ঐ করুন। রাজ্যের তামাম খেজুর গাছ শুমারের জন্যে লোক লাগিয়ে দিন।
পলাতকা তিন বেগমের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেছে তিন মাস খোঁজাখুঁজির পর। তাঁর সহগামী হিজড়ে প্রহরীটাও ধরা পড়েছে।
আমীর শিশমহলে আসেন। এসেই তিনি হিজড়ে প্রহরীদের সর্দারকে তলব করেন। মেয়েলি পোশাক পরিহিত সর্দার দিলবাহার আসে। কুর্নিশ করে দাঁড়ায় আমীরের সামনে।
-আসামী। বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে হাঁক দেন আমীর।
-হাজির করব, জাহাপনা?
-আলবৎ। হ্যাঁ, কি যেন নাম বেগমের?
-বেগম গুলফাম।
-নিয়ে এস।
সর্দার দিলবাহার কোমর দোলাতে দোলাতে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে। তার পেছনে বেগম গুলফাম। শঙ্কিত পদক্ষেপে নেন সর্দারকে অনুসরণ করছে। তার পায়ের নিচে মেঝেটা যেন দুলছে। কুর্নিশ করে সে জোড়হাতে দাঁড়ায় আমীরের সামনে!
আমীর দু’হাত তুলে ইশারা করতেই সর্দার ও বাঁদীরা সব বেরিয়ে যায়। রক্তচক্ষু মেলে তিনি তাকান বেগমের দিকে। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি আটকে যায় বেগমের কোমরের
নিচে। তিনি চমকে ওঠেন। উঠে দাঁড়ান কুর্সি ছেড়ে। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ভালো করে তাকান আবার। তারপর বেগমের মুখের দিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করেন, -যা দেখছি, এ কি করে হল?
বেগম নিরুত্তর। মুঠোয় ধরা পাখির মতো থর থর করে কাঁপছে তার সমস্ত শরীর।
-বল, জবাব দাও।
বেগমের দৃষ্টি আরো অবনত হয়।
-এ কেমন করে হল?
উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করেন আমীর, কে এর জন্যে দায়ী? বল উত্তর দাও।
-আমার স্বামী। কোন বদ্ধমুখ গুহার ভিতর থেকে যেন ক্ষীণ আওয়াজ বের হয়।
-তোমার স্বামী? সে তো আমি।
-আপনি পাঁচ বছর আগে আমাকে ত্যাগ করেছেন, জাহাঁপনা! আমি আবার শাদী করেছি।
-শাদী! কে, কে তোমার স্বামী? কি নাম তার?
-জুল কদর।
-জুল কদর! কে সে?
-কারিজা মহলের গোলাম।
গোলাম। সে তো হিজড়ে।
গুলফামের মুখ থেকে আর কোন কথা বেরোয় না। সে ভয়ে কাঁপছে। আমীরের সমস্ত শরীরে কে যেন বিছুটি লাগিয়ে দিয়েছে। তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, দিলবাহার।
জাহাপনা! ছুটে আসে হিজড়ে সর্দার। দু’নম্বর আসামী। হাঁক দেন আমীর।
হাত-বাঁধা আসামীকে আমীরের সামনে হাজির করা হয়।
আমীরের চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। তিনি আসামীর দিকে তাকান। দাড়ি-গোঁফের চিহ্নমাত্র নেই তার মুখে।
এ কি হিজড়ে?
হিজড়ে প্রহরীরা লম্বা চুল রাখে আর পোশাক পরে মেয়েদের মতো। কিন্তু এ পুরুষের পোশাক পরেছে, চুল ছাঁটিয়েছে পুরুষের মতো। আমীর বুঝতে পারে-লোকটা হিজড়ে নয়, মাকুন্দে।
আমীর চোখ ফিরিয়ে নেন। মাকুন্দেটার মুখ না দেখাই ভালো ছিল। দেশের একটি প্রবাদ: “যদি দেখ মাকুন্দের মুখ, ফাঁড়া নজগিদ, নজদিগ দুখ।”
আমীর কিছুক্ষণ চিন্তা করেন-এ গুরুতর অপরাধের শাস্তি কি? মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ড তো বটেই, কিন্তু কি উপায়ে, তা ঠিক করে উঠতে পারেন না তিনি। রাগে-ঘৃণায় বিকৃত হয় তাঁর মুখ। তিনি বা হাত তুলে কড়ে আঙুল নেড়ে ইশারা করেন-মাকুন্দেটাকে নিয়ে যাক, সরিয়ে নিয়ে যাক তাঁর সুমুখ থেকে।
রাত বেড়ে চলেছে। আমীর শিশমহলের সুবৃহৎ জলসা ঘরে পায়চারি করেন, আবার কখনো সোফায় গা এলিয়ে দেন। পাশ-টেবিল থেকে তুলে নেন পানপাত্র। চৌখা মহলের বেগম একের পর এক তিন বার ফুলের তোড়া পাঠিয়েছেন। চৌথা মহলেই আজ তাঁর রাত্রি যাপনের পালা। কিন্তু সেদিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। রাগ ও ক্ষোভের দাবদাহে তাঁর সর্বাঙ্গ জ্বলছে। ক্ষোভ তাঁর নিজের ওপরও কিছু কম হয়নি। তাঁর মনে একই কথা বারবার আনাগোনা করে-আগেকার দিনে রাজা-বাদশারা ক্রীতদাসদের খোজা করে হারেমে জায়গা দিত। আর তিনি একটা বেওকুফের মত রাজ্যের হিজড়েগুলোকে এনে হারেমে জায়গা দিয়েছেন। একটা মহান উদ্দেশ্য নিয়ে পুষছেন এ বিকৃতজন্মা মানুষগুলোকে। তার ফল ভালো করেই ফলেছে।
আবার তাঁর মনে হয়-কাজটা যে মহৎ, তা তাঁর কোন মহাশত্রুও অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু হারেমে ঢোকাবার আগে প্রত্যেকটাকে ভালো করে পরীক্ষা করা দরকার ছিল। এর জন্যে দায়ী হারেমের সর্দার দিলবাহার।
এবারে তাঁর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে সর্দারের ওপর। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে হিজড়ে সংগ্রহের ভার ছিল তারই ওপর। সে তার কাজে চরম গাফিলতি দেখিয়েছে। মৃত্যুদণ্ডই হবে তার উপযুক্ত শাস্তি।
হারেমের সমস্ত হিজড়েগুলোকে একবার পরীক্ষা করে দেখা দরকার সিদ্ধান্ত নেন আমীর। কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব। ডাক্তার বা বাইরের কোন লোককেই এ কাজের ভার দেয়া যায় না। বাইরে জানাজানির ভয় আছে, মান-ইজ্জতের প্রশ্ন আছে। না, মৃত্যুদণ্ডের আসামী সর্দার দিলবাহারকে দিয়েই হাসিল করতে হবে এ কাজ। এটাই হবে উত্তম ব্যবস্থা। হারেমের ঘটনার প্রধান সাক্ষী দিলবাহার। তার জান কবচের সাথে চাপা পড়ে যাবে এ কেলেঙ্কারী। -দিলবাহার। হাঁক দেন আমীর।
শিশমহলের বাইরে অপেক্ষা করছিল দিলবাহার। ডাক শুনে ছুটে আসে, কুর্নিশ করে সুমুখে দাঁড়ায়।
নিচু গলায় হুকুম শুনিয়ে আমীর বলেন, যাও। আজ রাত্রের মধ্যে কাজ সেরে কালই আমাকে জানাবে।
চৌথা মহলে অনেক বেলায় ঘুম ভাঙ্গ আমীরের। বেগম খবর দেন-পাঁচ জন হিজড়েসহ সর্দার দিলবাহার পালিয়েছে।
Leave a Reply