পিওতর মান্তেইফেল
কাক
নদীর বালুময় অগভীর একটা জায়গার ওপর ধাঁরে ধীরে উড়ছিল কাক।
প্রায় শেষ শক্তি নিঃশেষ করে সে যেন তার ডানা নাড়ছিল গুরুভার অনিশ্চিত ভঙ্গিতে। নিশ্চয় খিদেয় কাহিল হয়ে পড়েছিল কাকটা। হঠাৎ পাখিটা এক জায়গায় স্থির হয়ে ভেসে রইল। প্রথমটা সে কী যেন লক্ষ্য করলে। তারপর নিচে নেমে এল অল্প জলে পড়ে থাকা একটা শামুকের দিকে। সেটাকে ঠোঁটে করে কাকটা ফের ওপরে উঠে গেল।
কিন্তু পনের মিটার উচুতে উঠতে না উঠতেই ঠোঁট ফাঁক করে সেটাকে ফেলে দিলে নিচে। পড়ন্ত শামুকটার সঙ্গে সঙ্গে কাকও নেমে এল নিচে। শামুকটা পড়ল বালিতে, কোনোই ক্ষতি হল না।
তিনবার ওপরে উঠে তিনবারই একই শামুককে ফেলে দিলে কাক।
তাতে একেবারেই সে হয়রান হয়ে গেল। কিন্তু নদীর তীরে খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে সে ফের ওপরে উঠল কয়েক মিটার, একটা পাথুরে ঢিপির ওপর খানিক পাক দিয়ে ফিরে এল শামুকটার কাছে।
চতুর্থ বার কাক শামুকটাকে ফেললে কেবল তখন, যখন নিচে দেখা গেল পাথর। এবার শেষ পর্যন্ত ভেঙে গেল তার চুনা পাথরে খোলা। শক্ত পায়ে শামুকের খোলা আঁকড়ে ধরে ক্ষুধার্ত পাখিটা লোভীর মতো ঠোকরাতে লাগল ভেতরকার মাংসে।
স্যাতে কাহিনীটা আমায় চিঠিতে জানান আ. সেদিখ, কাকের অধ্যবসায় দেখে অবাক হয়ে যান তিনি। সত্যিই, বাস্তব জীবনের পরিস্থিতি বহু, প্রাণীর মধ্যেই এমন কতকগুলো অভ্যাস গড়ে উঠেছে, যাতে বেশ সংকটজনক অবস্থা থেকেও পরিত্রাণ পেয়ে যায় তারা।
হায়ারে কাদাখোঁচারা শামুকের খোলা ভাঙে একটু অন্যভাবে। ঠোঁটে নিয়ে সেটাকে সে পাথরে ঠুকে ঠুকে ভাঙে।
অন্যান্য পাখির মধ্যে কাকের মস্তিষ্কই বেশি বিকশিত। তাই কাককে পর্যবেক্ষণ করে অতি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা দেখা যায় প্রায়ই।
উরাল থেকে এই রকম একটা ঘটনার কথা আমাদের লিখে জানান শিকারী কচিওনি।
উরালে কাজ করার সময় এই খনি-ইঞ্জিনিয়রটি ‘হাত মক্স করার’ জন্যে রোজ কাকদের গুলি করতে শুরু করেন। কিন্তু দু’তিন দিন পরেই দূরে তাদের শত্রুকে দেখতে পাওয়া মাত্র কাকেরা উড়ে যেত আর গুলির পাল্লা পেরিয়ে গিয়ে তবেই বসত পাইন গাছের ডগায়।
তখন সব রকম সাবধানতার সঙ্গে ইঞ্জিনিয়র ওঁৎ পাতলে গোলা-ঘরে, যে আস্তাকুড়েটার কাছে কাকেরা সাধারণত জটলা করত, তা থেকে অল্প দূরে। কিন্তু ওঁৎ পাতার জায়গায় ওঁকে ঢুকতে দেখেই কাকেরা মুহূর্তে উড়ে গিয়ে
পাইন গাছ ছেয়ে ফেলে। আন্তাকড়টায় তারা নেমে আসে কেবল ইঞ্জিনিয়র জায়গাটা ছেড়ে যাবার পরে।
পরের দিন ইঞ্জিনিয়র গোলা-ঘরে ঢোকেন আরেকজন সঙ্গী নিয়ে, মিনিট দুয়েক পরেই লোকটা পাইন গাছে বসা কাকেদের সামনে দিয়ে ফিরে যায়। পরিকল্পনাটা খুব সহজ: কাকেরা দেখবে একটা লোক বেরিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন ফের আস্তাকুড়ে নেমে আসবে।
কিন্তু এতেও তাদের ঠকানো গেল না। বেজার হয়ে ইঞ্জিনিয়র প্রাতরাশের জন্যে বাড়ি ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত একটা কাকও ত্যাগ করল না তাদের নিরাপদ ঘাঁটি।
অসফল শিকারীর একেবারে আঁতে ঘা লাগল: উচ্চ শিক্ষায়তন থেকে ভালো-
ভাবে পাশ-করা ডিপ্লোমা-পাওয়া একটা লোক কিনা পেরে উঠছে না সাধারণ কাকেদের সঙ্গে! এবার তিনি গোলা-ঘরে ঢুকলেন দু’জন সঙ্গী নিয়ে, তারপর ফেরত পাঠালেন তাদের।
তারা অদৃশ্য হতে ইঞ্জিনিয়র আশা-ভরে তাকিয়ে রইলেন ফাটলের মধ্য দিয়ে… কাকগুলো কিন্তু বসেই রইল গাছে।
‘না, হার মানব না!’ এই স্থির করে শিকারী গোলা-ঘরে ঢুকলেন তিন জন সঙ্গী নিয়ে।
এইবার তাঁর জয়ের পালা! তিন জনেই যখন গোলা-ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল, তখন ঝাঁক বেঁধে কাকেরা নেমে এল আস্তাকুড়ে।
চিঠিতে কমরেড কচিওনি লিখেছেন, ‘দৈবাৎ করে ফেলা এই পরীক্ষাটা থেকে একটা সিদ্ধান্ত টানা যায়: লোকে প্রায়ই কাকেদের গোণে, কাকেরাও মানুষ গোণে, যদিও তিনের বেশি গণনা-শক্তি তাদের নেই।’
ব্যাপারটা গোণা নিয়ে? খুবই সম্ভব যে কাকেরা তাদের ‘শত্রুর’ চেহারাটা মনে করে রেখেছিল, চলে-যাওয়া লোকগুলোর মধ্যে তাকে দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত গাছের ডগা থেকে নামত না। কিন্তু গোলা-ঘর থেকে যখন তিন জন বেরিয়ে ঘেষাঘেষি করে আঙিনা ছেড়ে যায়, তখন অন্য কাউকে শিকারী বলে ভুল করা তাদের পক্ষে খুবই সম্ভব।
সাধারণত লোকের মুখ আর চেহারা চমৎকার মনে রাখতে পারে কাকেরা, বিশেষ করে যারা তাদের জালায়।
Leave a Reply