পিওতর মান্তেইফেল
তোরাঙ্গিকোল হ্রদে
ইব্রতীশ নদীর উজান এলাকা পর্যবেক্ষণ করার সময় তোরাঙ্গিকোল হ্রদের উপকূলে ঝোপের মধ্যে শিপুন-জাতের একটা রাজহাঁস পরিবার আমার চোখে পড়ে এবং তাদের লক্ষ্য করতে থাকি।
মা-বাপ ছাড়া সংসারটিতে ছিল আরো তিনটি ধূসর রঙের বাচ্চা। তখন হেমন্ত, দক্ষিণে উড়ে যাবার তোড়জোড় করছিল তারা। হ্রদ ছেড়ে তাদের বাসাটা থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়েও গেল। হঠাৎ একটা বাচ্চা উড়ন্ত পাখির দল ছেড়ে ফিরে এল আবার। তার পেছু পেছু ফিরল বাকিরাও। অনেকখন বাতাসে পাক খেল ধাড়ী- দুটো, নানাভাবে সপরিবারে উড়ে যাবার জন্যে বাচ্চাটাকে উসকাল তারা। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটা তাদের সঙ্গেই উড়ে গেল, কিন্তু আবার ফিরে এল। এই চলল কয়েক বার। বাসা পাতার জায়গাটার বার বার চক্কর দিলে দুটো ধাড়ী আর দুটো বাচ্চা। অন্য বাচ্চাটা ওদের সঙ্গে উড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু অচেনা জায়গায় পৌছতেই আবার ফিরে আসছিল। শেষ পর্যন্ত গোটা সংসার উড়েই গেল, হ্রদে আর ফিরল না, শুধু বাচ্চাটা রইল শাঁত ভুগতে। জোরালো দূরবীণ দিয়ে আমি রয়ে-যাওয়া রাজহাঁসটাকে দেখতে লাগলাম। বাইরে থেকে সে দেখতে সুস্থ-সমর্থ, কোনো ত্রুটি নেই, তবে ক্যাঁ-ক্যাঁ করে ডাকছিল আর খুজেছিল তার মা-বাপকে। ব্যাপারটা কী? তোরাঙ্গিকোল-বাসী অন্যান্য রাজহাঁসের সঙ্গে হেমন্তে সে উষ্ণ দেশে উড়ে গেল না কেন?
হয়ত ঋতুচক্র মেনে উড়ে যাবার প্রেরণা পাখিটার মধ্যে নেই? তোরাঙ্গিকোলের তাঁর ছেড়ে আসার সময় বেশ বুঝলাম, ও আর তার আত্ম-পরিজনের মুখ দেখবে না কখনো, আরো উত্তরের কোনো হ্রদ থেকে উড়ে আসা অন্যান্য রাজহাঁসদের দলে যদি সে না ভেড়ে, তাহলে শীতের ঠান্ডায় তার মৃত্যু অনিবার্য।
যাযাবর পাখিদের মধ্যে উড়ে যাবার প্রবণতার এই অভাব দেখা যায় কদাচিৎ। তাই স্বভাবতই ভিয়াজমা শহরের উপকণ্ঠে কতকগুলো যাযাবর দাঁড়কাককে শীত কাটাতে দেখে আমরা তার কারণ জানতে কৌতূহলী হয়ে উঠি।
এই ধরনের পনেরোটা কাককে গুলি করে মারি আমরা। দেখা গেল, সবকটারই কোনো-না-কোনো খখুত আছে। যেমন, একটার নিচের চোয়ালের আধখানা নেই, কখনো নিশ্চয় গুলিতে খসে গেছে; আরেকটার কোনো এক সময় পাখার হাড় ভেঙে গিয়েছিল, সেটা ঠিকমতো জুড়ে ওঠে নি। আরেকটার দুটো আঙুল নেই; আরেকটার পেশীর গভীরে ঢুকে গেছে ছত্রা। সবকটারই এক-একটা ত্রুটি। এইসব ক্ষতির ফলেই কাকগুলো লম্বা পাড়ি খারিজ করতে বাধ্য হয়।
মস্কোর চিড়িয়াখানায় বহু জাতের বুনো হাঁসের মধ্যে দেখা যায় বসন্তে ও শরতে উড়ে যাওয়ার তাঁর প্রবণতা, কিন্তু মস্কোতেই তারা থাকে একমাত্র এইজন্যে যে তাদের পাখার ডগার হাড়টা কেটে ফেলা। এসব হাঁস আকাশের অনেক উচুতে ওঠে, শহরের ওপর ওড়ে অনেকখন ধরে, কিন্তু বেশি দূরে পাড়ি দেয় না। পাখার ডগা-কাটা পেলিকানরাও বসন্ত ও শরতে মস্কোর রাস্তার ওপর দিয়ে উড়ে যায়, কিন্তু তারপর সর্বদাই চিড়িয়াখানায় ফিরে আসে, শীত কাটায় মস্কোতেই। খুবই সম্ভব যে তোরাঙ্গিকোল হ্রদে শীত কাটাবার জন্যে যে রাজহাঁসটা রয়ে গেল, তারো কোনো অঙ্গহানি ছিল।
Leave a Reply