শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:২৪ পূর্বাহ্ন

আতাউস সামাদ অদম্য সংগ্রামী সংবেদনশীল সাংবাদিক

  • Update Time : শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮.০০ এএম

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

(বরেণ্য সাংবাদিকের মৃত্যুর যুগপূর্তি উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি)

সাংবাদিক আতাউস সামাদের কণ্ঠের সঙ্গে পরিচয় স্কুলজীবন থেকে। সে সময় ‘বিবিসির আতাউস সামাদ’ বাড়িতে, পথে সবখানেই আলোচিত। দেশে সম্প্রচারিত টিভি চ্যানেল বিটিভি এবং রেডিও বাংলাদেশ সরকারি কঠোর নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বাসযোগ্য কোনো খবর সেখানে পাওয়া যায় না। সামরিক শাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সর্বশেষ খবর পেতে দোকানে, বাড়িতে সবখানে প্রধানত বিবিসি-ই ভরসা। অনেক শ্রোতা আগ্রহ নিয়ে শুনতেন বিবিসিতে ঢাকা থেকে পাঠানো আতাউস সামাদের প্রতিবেদনগুলো। তার কণ্ঠস্বর সবার কাছেই পরিচিত হয়ে ওঠেছিল। এই সাহসী সাংবাদিকতার জন্য তাকে জেলে পাঠায় সামরিক সরকার। বন্দী আতাউস সামাদ আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। অচেনা, অজানা মানুষটি কীভাবে যেন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সদস্য হয়ে গেলেন! দেশের যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বড় কোনো ঘটনা ঘটলে অনেকেই জানতে চাইতেন বিবিসির আতাউস সামাদ কী বললেন। তার বক্তব্য শোনার পর মনে এক ধরনের সন্তুষ্টি কাজ করতো।

এই অসাধারণ মানুষটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৯৬ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় কাজের সুযোগ হয় সে সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এ। এসময় একদিন সাংবাদিক আতাউস সামাদ বেইলি রোডে যায়যায়দিন অফিসে আসেন। সিনিয়র সাংবাদিক ও যায়যায়দিনের সহকারী সম্পাদক স্বদেশ রায় তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ধবধবে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে স্বভাবসুলভ বিনয়ী হাসি নিয়ে তিনি এমনভাবে কথা বললেন যেন আমি তার বহুদিনের পরিচিত। সম্পর্ক তৈরি হতে সময় লাগে নি। সংবাদপত্রের সংস্কৃতি অনুসারে অন্যদের মতো আমিও তাকে ‘ভাই’ বলে ডাকা শুরু করি। তারপর দিন যতো গেল এই বিনয়ী মানুষটি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে লাগলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করতেন। অনেক খ্যাতনামা সাংবাদিক তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করেন। সাংবাদিকতায় সারাজীবন সাধকের মতো তপস্যা করেছেন তিনি। একজন পরিপূর্ণ সাংবাদিক বলতে যা বোঝায় তিনি তাই ছিলেন। ততোদিনে তার সঙ্গে যে সর্ম্পক গড়ে ওঠেছে তাতে ‘ভাই’ থেকে আর ‘স্যার’ সম্বোধনে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি হয়ে ওঠলেন পরম কাছের মানুষ। সামাদ ভাই। সাংবাদিক আতাউস সামাদ ছিলেন তার কাজের বিষয়ে আক্ষরিক অর্থেই ভীষণ রকমের পারফেকশনিস্ট। প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ নিয়ে তিনি ভাবতেন এবং কোথায় কী লিখেছেন তা বিস্ময়কর ভাবে মনে করতে পারতেন। লিখতেন রুলটানা ফুলস্কেপ কাগজে। ছোট ছোট গোটা গোটা হাতের লেখা ছিল তার। যায়যায়দিনে তিনি নিয়মিত লিখতেন। যে রাতে ম্যাগাজিন প্রেসে যাবে তখনো তিনি শেষ মুহূর্তে কোনো আপডেট বা পরিবর্তন করতে ফোন করতেন। কোন পৃষ্ঠার, কোন লাইনে, কোন শব্দ বদলাতে হবে কিংবা কোথায় কোন নতুন লাইন ঢুকবে টেলিফোনে সেই নির্দেশনা দিতেন। ঠিক সেই সময়টাতে তার ফোন ধরতে অনেকে ভয় পেতেন! নতুন হিসাবে আমি এই দায়িত্ব পেলাম। সাংবাদিক আতাউস সামাদের নির্দেশনা মেনে ঠিক মতো লেখা বসিয়ে টেলিফোনে তাকে পড়ে শোনাতে হতো। তখনও তিনি কিছু সংশোধনী বা আপডেট দিতেন। এক সময় তার লেখালেখি ঠিক করার বিষয়টি অলিখিতভাবে আমার ওপর এসে পড়লো। এই কাজগুলো করার সুযোগ পেয়েছিলাম বলে তার সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর হয়ে ওঠে।

সাংবাদিক আতাউস সামাদ প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করতেন এবং তার টেলিফোন আলাপ কমপক্ষে এক ঘণ্টা হতো। এক সময় মনে হলো, তিনি আমাকেও হয়তো পছন্দ করতে শুরু করেছেন। তখন মোবাইল ফোনের ব্যবহার ততোটা শুরু হয়নি। ল্যান্ডফোনে কথা হতো। সম্পাদক শফিক রেহমান, সহকারী সম্পাদক স্বদেশ রায় কিংবা নিয়মিত লেখক সাংবাদিক আমীর খসরুর টেলিফোন দীর্ঘসময় ব্যস্ত থাকলে বুঝে নিতাম সাংবাদিক আতাউস সামাদ ফোনে কথা বলছেন। তারাও বুঝে নিতেন আমার বেলায়। রাতে বাসায় আব্বা বলতেন, দ্রুত খেয়ে নাও, সামাদ সাহেব ফোন করবেন!

একটা সময় প্রতিদিনই টেলিফোনে তিনি কথা বলতেন। তার মূল আলাপ হতো সাংবাদিকতা , রাজনীতি, সমাজ এবং প্রতিদিনের প্রকাশিত পত্রিকার রিপোর্ট নিয়ে। যখন কিছুটা পরিচিত হলাম তখন তার সাংবাদিক জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা জানাতে লাগলেন। কোনো নতুন বিষয় জানলেই সেটা শেয়ার করতেন আমাদের সঙ্গে। একটা সময় এমন হলো যে, তিনি ফোন করলেই বুঝতে পারতাম সেদিন তার মুড কেমন আছে। তার শিশুর মতো সরল হাসি, কোনো কারণে রেগে যাওয়া, স্মৃতিচারণ, আবেগ, অভিমান সবই বোঝা যেত। খুবই সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন তিনি। তার কথা ঠিক মতো না শুনলে অভিমান করতেন। প্রতিটি বিষয়ে সিনসিয়ার ছিলেন। অন্যদের কাছ থেকেও একই ধরনের সিনসিয়ারিটি আশা করতেন। তিনি কৌশলী মানুষ কখনোই ছিলেন না। তার অনুভূতি সরাসরি প্রকাশ করতেন। এতে কোনো রাখঢাক ছিল না। খুব খুশি হলে ঘাড় কাত করে এমন একটা হাসি দিতেন যে মন ভালো হয়ে যেত। টেলিফোন আলাপে আমি ছিলাম শ্রোতা। শুধু ‘বলেন কী!’, ‘তাই নাকি’, ‘জ্বী’ ইত্যাদি টুকটাক কথা বলে যেতাম।

আমি তার সাংবাদিকতা ক্লাসের ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আবিষ্কার করলাম প্রতিদিনের টেলিফোন আলাপের মাধ্যমে তিনি শিক্ষকতার কাজটিই নিরবে করে যাচ্ছেন। সাংবাদিকতার এবিসিডি শিক্ষায় সম্পাদক শফিক রেহমানের পর তিনি হয়ে ওঠলেন আমার দ্বিতীয় শিক্ষক। যায়যায়দিনে আমার লেখা বা কোনো রিপোর্ট প্রকাশের পর সেই লেখার প্রতিটি লাইন প্রথমে তিনি খুঁটিয়ে পড়তেন। তারপর আলাপ করতেন। কোথায় কোন ভুল করেছি। কোথায় আরো কী কী তথ্য দেয়া প্রয়োজন ছিল। আরো কীভাবে লেখাটি ভালো করা যেত সেটা বলতেন। কখনো কোনো লেখা ভালো লাগলে সেটা জোরে জোরে পড়ে শোনাতেন। একই সঙ্গে লজ্জা এবং ভালো লাগা কাজ করতো তখন। তার নিজের লেখার মধ্য থেকে অনেক কিছু শেখার থাকতো। যায়যায়দিনে একাধিক লেখা যখন তিনি শুরু করলেন, তখন একটির লেখক নাম দিলেন ‘মিতবাক’। নামটি তার স্বভাবের সঙ্গে কতোটুকু সঙ্গতিপূর্ণ হলো সেটা যখন ভাবছিলাম তখন এই নামের লেখাগুলোতে পড়লাম ও বুঝলাম কতো অল্প শব্দে তিনি কতো কঠিন বিষয়কে টেনে নিয়ে আসতেন।

অসাধারণ সংগ্রামী ও বৈচিত্রময় ছিল সাংবাদিক আতাউস সামাদের জীবন। পাকিস্তানি আমল থেকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি কখনো কলমে, কখনো কণ্ঠে, কখনো শারীরিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে একজন সাংবাদিক হিসাবে তার ভূমিকা এবং তার পুরো পরিবারের ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত অনন্য। তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে কয়েকবার। মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য ঘটনার কথা তার কাছ থেকে শুনেছি। একবার প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে যদি হত্যা করা হয় তবে কী মুক্তিযুদ্ধ থেমে যাবে?’ অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই বিষয়টির ওপর বিস্তারিত তথ্য নিয়ে তিনি নির্বিকারভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের পক্ষে তথ্য সংগ্রহকারী জিয়াউল হক টুলুর কাছে। আগ্রহ নিয়ে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সামাদ ভাই প্রশ্নের উত্তরটি কি ছিল?

তিনি কিছুটা নিরব থেকে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিলেন, ‘থামবে না। মুক্তিযুদ্ধ চলতেই থাকবে।’ মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিক আতাউস সামাদের বড় ভাই আজিজুস সামাদকে পাকিস্তানি সেনারা বন্দী শিবিরে অমানুষিক নির্যাতন করে। আজিজুস সামাদের বড় ছেলে আশফাকুস সামাদ বীরউত্তম যুদ্ধে শহীদ হন। আতাউস সামাদের আরেক ভাতিজা ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ উলফাত। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আলোচিত আইনজীবী সিরাজুল হক তার দুলাভাই এবং আনিসুল হক তার ভাগিনা। পরিবারের প্রতি সাংবাদিক আতাউস সামাদের ছিল সীমাহীন দুর্বলতা। কখনো কখনো তা তার পেশাগত জীবনে যে সমস্যা করেনি, তা নয়। আতাউস সামাদের বাবা আবদুস সামাদ ১৯৩৫ সালে বৃটেনের লিডস ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নেন। চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রমুখ ছিলেন তার ব্যক্তিগত বন্ধু। বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন আবদুস সামাদের সরাসরি ছাত্র।

সাংবাদিক আতাউস সামাদ জন্মেছেন ১৯৩৭ সালের ১৬ নভেম্বর। বর্তমানের কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ এলাকায়। ১৯৫৭ সালে ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। শুরু পাকিস্তান অবজারভার দিয়ে। এ সময় সাংবাদিক এবিএম মূসা ছিলেন তার নিউজ এডিটর। সাংবাদিক এবিএম মূসা, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের মতো সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রতি তার শ্রদ্ধার প্রকাশ ছিল সর্বাবস্থায়। তিনি সাংবাদিকতার পরম্পরা বজায় রাখতেন পরম যতেœর সঙ্গে। সাংবাদিক এবিএম মুসা নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে তাকে বিভিন্ন স্পটে নিয়ে যেতেন সে কথা তার কাছ থেকে বহুবার শোনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দিল্লি থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধুর বিমানের সঙ্গী ছিলেন সাংবাদিক আতাউস সামাদ। সে সময় বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে তিনি কাজ করেছেন বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, বিবিসি, আমার দেশ, এনটিভিসহ দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। আমার দেশ ও এনটিভি অফিস আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর সাংবাদিক আতাউস সামাদের আরেক সাহসী রূপ দেখার সুযোগ হয়েছিল কাছ থেকে। পত্রপত্রিকা, রেডিও এবং টেলিভিশন তিন মাধ্যমেই কাজ করেছেন তিনি। ওয়ান ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনের সময় তার সাহসী লেখা অনেকের জন্যই প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে। নীতির প্রশ্নে তিনি সৎ ও সরব থাকার চেষ্টা করেছেন সবসময়।

সাপ্তাহিক এখন-এর সম্পাদক ও প্রকাশক হিসাবে কাজ শুরুর পর তার ব্যস্ততা আরো বেড়ে যায়। নয়া পল্টনের মসজিদ গলিতে পুরানো আমলের ‘ওয়েসিস’ নামের পারিবারিক বাড়িতেই হয় সাপ্তাহিক এখন-এর প্রথম অফিস। বাড়িটি তার খুব প্রিয় ছিল। এর যে চারপাশ থেকে আলো ও বাতাস আসে তা তিনি আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। দোতলায় তার বই ভর্তি স্টাডি রুমে বসে বহুদিন গল্প করার সুযোগ হয়েছে। তার স্ত্রী কামরুন নাহার রেনু নানা ধরনের খাবার পাঠাতেন তখন আমাদের জন্য। তার দুই মেয়ে এক ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার। বাড়িতে হাফ হাতা স্যান্ডো গেঞ্জি এবং লুঙ্গি পরতেন তিনি। অনেক সময় এই বেশেই নিচতলার অফিসে চলে আসতেন।

সাপ্তাহিক এখন-এ সাংবাদিক হিসাবে কাজ করার বিষয়ে তার কাছ থেকে আমন্ত্রণ প্রত্যাশিত হলেও উত্তর দেয়া ছিল বেশ বিব্রতকর। যায়যায়দিন ছাড়ার কথা চিন্তা করতে পারিনি। অভিমান করেছিলেন তিনি। কিন্তু অল্পদিনেই আবার সব স্বাভাবিক। সাপ্তাহিক এখন-এ অনেকের লেখা ছাপাতে কিংবা কারো চাকরির জন্য তাকে অনুরোধ করেছি। তিনি চেষ্টা করেছেন আমার কথাকে গুরুত্ব দিতে। তবে নয়া পল্টনের বাসা ছেড়ে বারিধারা চলে যাওয়ার পর যোগযোগ কিছুটা কমতে শুরু করে। বাড়ি বদল, শারীরিক দুর্বলতা,দৈনিক আমার দেশের ব্যস্ততা এবং সাপ্তাহিক এখন নিয়ে সংগ্রাম তাকে কারো কারো কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দেয়। ল্যান্ডফোনের জায়গায় মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহারেও সেই দূরত্ব নানা কারণে কমাতে পারেনি Ñ একথাও সত্য। তবে যখনই কোথাও দেখা হয়েছে কিংবা ফোনে কথা হয়েছে- একই ভাবে কুশল জানতে চেয়েছেন। নিশাতকে নিয়ে বারিধারায় যখন দেখা করতে গিয়েছি, ফেরার সময় ফ্ল্যাট থেকে পথে নেমে এগিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।

ইতিহাস ও ঐতিহাভিত্তিক মাসিক জার্নাল রুটস প্রকাশের সময় যে অল্প কয়েকজন মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সাংবাদিক আতাউস সামাদ তাদের একজন। ৫ জুন ২০০৮ তারিখে রুটসের প্রথম সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন তিনি। আমার দেশে খবরটি ছাপানোর ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। নিজের প্রয়োজন শুধু নয়, পরিচিত অনেকের জন্য তার কাছে সুপারিশ করেছি আবদারের সুরে। তিনি শুধু বলতেন, পাঠিয়ে দাও।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজা রাখাসহ ধর্মীয় বিধান তিনি আন্তরিকভাবে মেনে চলতেন। একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসাবে অন্য ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল সব সময়। একবার টাঙ্গাইলে পূজা মণ্ডপ ঘুরে আসার পর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছেন কোথাও কোনো সমস্যা চোখে পড়েছে কিনা। উপস্থিতি স্বাভাবিক ছিল কিনা। বেঞ্চে কতো জন করে বসেছিলেন।

তিনি বড় সাংবাদিক ছিলেন, একই সঙ্গে অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন। পরিচিত মানুষের বিপদে এমন ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তেন যেন সমস্যাটি তার নিজের। সমস্যার সমাধান হোক বা না হোক তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করতেন। ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে দেশ জুড়ে চলতে থাকা আনন্দের দিনে সউদি আরব থেকে একটি ফোনকল আমাদের পারিবারিক আনন্দ প্রদীপ নিভিয়ে দেয়। হজ শেষে আব্বার দেশে ফিরে আসার অপেক্ষায় যখন আমরা, তখন সোনালি ব্যাংকের এক জুনিয়র সহকর্মী তার মৃত্যু সংবাদ জানান। একটি মাত্র ফোনকল। আর কোনো যোগাযোগ নেই। ঈদের ছুটির কারণে সব বন্ধ। মোবাইল বা ইন্টারনেটের ব্যবহার ছিল না। ল্যান্ডফোনে কাউকেই পাওয়া যাচ্ছিল না। একের পর এক জায়গায় ছুটছিলাম বিস্তারিত জানার জন্য। আসলে নিশ্চিত হতে। হজ ক্যাম্প, মন্ত্রণালয়, সোনালি ব্যাংক-কোথাও কোনো তথ্য পেলাম না। রাতে বাসায় ফিরে শুনি সাংবাদিক আতাউস সামাদ অন্তত পাঁচবার ফোন করে আমার খোঁজ জানতে চেয়েছেন। তাকে ফোন করতেই জানালেন এরই মধ্যে সউদি আরবে তার যতো পরিচিত আছেন সবাইকে একাধিকবার ফোন করেছেন। সোনালি ব্যাংকের এমডি, যিনি তার বন্ধু ছিলেন, তাকেও কয়েকবার ফোন করেছেন বলে জানান। পুরো ঘটনায় কয়েকটি দিন সাংবাদিক আতাউস সামাদ এতো বেশি জড়িয়েছিলেন যে বিষয়টি নিয়ে তিনি যায়যায়দিনে একটি লেখা লিখেছিলেন। লেখাটির শিরোনাম ছিল- ‘মৃত্যু সংবাদ যখন আলেয়া’।

আমার কাছে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে ৭৫ বছর বয়সে অ্যাপোলো হসপিটালে তার হঠাৎ মৃত্যুটিকেও মাঝে মাঝে আলেয়া মনে হয়। মনে হয় যে কোনো সময় ফোন বেজে উঠবে। আগের মতো ওপাশ থেকে বহুবার শোনা অতি পরিচিত একটি কণ্ঠ বলবেন, হ্যালো, কে মাহমুদুজ্জামান? শোনো, আমি আতাউস সামাদ বলছি।’

লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024