শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:৩৩ পূর্বাহ্ন

বিএনপির ভুল ও সঠিক

  • Update Time : বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ১২.৩৫ এএম

 

স্বদেশ রায়

 

২০২৪ এর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দুই বছর আগের থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন করে বিএনপি। ওই আন্দোলনের চরিত্র পর্যালোচনা করলে তিনটি বিষয় সামনে আসে। এক, বিএনপি এমনভাবে তাদেরকে উপস্থিত করছিলো যাতে পশ্চিমা বিশ্ব দলটিকে উদার গণতান্ত্রিক দল মনে করে। দুই, দেশের মানুষও তাদেরকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে গ্রহন করে। তিন, সাধারণ মানুষকে তাদের কর্মীদের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে  সরকারকে বাধ্য করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে।

 

পশ্চিমা বিশ্বের কাছে নিজেদেরকে এভাবে উপস্থিত করতে গিয়ে বিএনপি যা যা করেছে তা সবই দেশের মানুষ ও যারা বাংলাদেশের রাজনীতির খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন। সে বিষয় আর পুনরুল্লেখ না করে বলা যায়, বিএনপি নীতি নির্ধারকগন বর্তমানের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বুঝতে ভুল করেন। বিশেষ করে ভবিষতে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর ঘিরে যে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক মেরুকরণ হতে চলেছে এবং এই মেরুকরণের সঙ্গে জড়িত শক্তিগুলোর অনেক গুলো কেন্দ্রবিন্দুও রয়েছে।  বিএনপি ওই কেন্দ্রবিন্দুগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি। তারা মনে করেছিলো শুধুমাত্র নিজেদেরকে উদার গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরলেই তারা ভূরাজনৈতিক এই সমীকরণে উতরে যেতে পারবে।

 

ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর ঘিরে যে ভূরাজনৈতিক সমীকরণ সেখানে শুধুমাত্র নিজেদেরকে উদার গণতান্ত্রিক প্রমান করার চেষ্টা করাটাই যে যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও কানকেটিভিটি সহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রয়েছে বিএনপি সে সব ক্ষেত্রে খুব বেশি কাজ করতে পেরেছে বলে কোন প্রমান নেই। বরং তার অনেক কিছুর গভীরে বিএনপি যেতে পারেনি বলে দৃশ্যমান হয়েছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের হিসেব নিকেষ যতটুকু বাইরের থেকে বোঝা গেছে তা দেখে মনে হয়েছে তারা যেন বিশ বছর আগের ভূ রাজনৈতিক সমীকরণে বসে অঙ্ক মেলাচ্ছেন।

অন্যদিকে দেশের বাইরে ও দেশের মানুষের কাছে বিএনপি যে বর্তমান ক্ষমতাসীনের থেকে বেশি গণতান্ত্রিক বা উদার গণতান্ত্রিক সেটা প্রমানের জন্যে  তারা যদি মনে করে থাকে দুই বছরের অহিংস আন্দোলনই যথেষ্ট- তা হলে তাকে ভুলই বলতে হবে। সত্যি অর্থে ১৯৯১ সালে সংসদের বিরোধী দলের আনা সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার বিলের সঙ্গে সরকারি দল হয়েও একমত হওয়া ছাড়া বিএনপির ওই ভাবে আরো কোন বড় উদার গণতান্ত্রিক কাজের উদাহরণ নেই।

 

তাই বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিপরীতে তাদেরকে উদার গণতান্ত্রিক হিসেবে নিজেদের প্রমান করার কাজটি আদৌ সহজ কোন বিষয় নয়। আজ যারা বলছেন, বিএনপিকে বেশ কিছু  গণতান্ত্রিক শক্তি অনেক বেশি আশা দিয়েছিলো, পরে তারা মই সরিয়ে নিয়েছে। একটু শান্ত মাথায় হিসেব করলে তারা মনে হয় তাদের হিসেবের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করবেন। বাস্তবে বাইরের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো তাদের অবস্থানেই ছিলো। বিএনপি ও তাদের পরামর্শকরা নিজেকে না দেখে অনেকটা দীঘল সূর্যালোকে নিজের ছায়াকে দেখেই তাদের শরীরের দৈর্ঘ্য মেপেছিলো বলেই- নিজেদেরকে বেশি দীর্ঘ মনে হয়েছিলো।

 

অন্যদিকে, তারা যে দেশের মানুষকে তাদের কর্মীদের সঙ্গে একত্র নামিয়ে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেনে নিতে বাধ্য করবে বলে হিসেবে করেছিলো- এই হিসেবটিতেও তারা তাদের নিজেদের শরীরের দৈর্ঘ্য যেমন সঠিকভাবে দেখেননি তেমনি তারা ইতিহাসের পাতাগুলো উলটে হিসেবটি করেননি। ইতিহাসের পাতাগুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা করলে তাঁরা দেখতে পেতেন রাজপথে শরীরের দৈর্ঘ কতটা লম্বা হলে বা ইতিহাসের পাতা কোন বিন্দুতে পৌঁছালে প্রশাসনের ভেতর তার ছাপ পড়ে। আর সেই ছাপ ছাড়া ইতিহাসের পাতার ঘটনাগুলো ঘটেছে কিনা তাও তারা বুঝতে পারতেন।

 

বিএনপে ২৮ অক্টোবর ২০২৩ যে জনসভা করে ওই মাপের জনসভা মালেক- রাজ্জাক নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগও ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে অনেক গুলো করেছিলো। তারপরেও ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিলো। তারা জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের অবসান এমনকি  জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট ও চিফ মার্শল’ল পদ থেকে পদত্যাগ করবেন এ জন্য অপেক্ষা করেনি। কারণ, তারা জানতো তাদের এই রাজপথের ছায়া প্রশাসনের ওপর কোন ছাপ ফেলছে না। আর সে হিসেব করেই তারা তাদের রাজনীতি নিয়ে এগিয়েছিলো। যেমন ৭৮ সালে জেনারেল  ওসামানীকে গনতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে সমর্থন করে আওয়ামীলীগ যখন নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন দলের তরুণ কর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক বিরোধীতা ছিলো। সে সময়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতার মত ছিলো, অন্তত এই নির্বাচনের সুযোগে তারা তিন বছর পরে সাধারণ মানুষের সামনে তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বাজাতে পারবে। তাছাড়া তাদের সংগঠনের দশ বিশ ভাগ কর্মীও যদি রাস্তায় বের হয়ে কাজ করতে পারে সেটাও ভবিষতের পথে কিছুটা হলেও লাভ।

 

ঠিক একই ধরনের ইতিহাসের পাতা দেখা যায় ১৯৭৯’র সংসদ নির্বাচনে। সামরিক আইনের মধ্যে ওই নির্বাচনে গেলে শোচনীয় পরাজয় হবে এ ছিলো নির্ধারিত। তবু আওয়ামী লীগের দুই দিনের বর্ধিত সভায় নানা মতের বির্তকের পরেও সিদ্ধান্ত হয় নির্বাচনের যাওয়ার। সেখানেও সিনিয়রদের মত ছিলো, যতটুকু নিয়ন্ত্রিত পার্লামেন্টের ভাগ পাওয়া যায় সেটাও ভবিষ্যতের জন্যে ভালো। কারণ, অতটুকু অংশ নিয়েও তো কিছুটা হলেও প্রশাসনের সঙ্গে থাকা যাবে। দুই, দশ জন জনপ্রতিনিধিও যদি পার্লামেন্টে কথা বলে তাহলে তারা যতটা উম্মুক্ত কথা বলতে পারবে রাজপথে একশ জন নেতাও সেটা পারবে না।

 

বিএনপি যে আওয়ামী লীগের অতীতের পথ ধরে হাঁটবে তা নয়। তারপরেও ২৮ অক্টোবর বিএনপির জনসভা ভেঙ্গে যাবার আগ মুহূর্তে যে কর্মসূচী তাদের নেতা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা করেনতার কি কোন বিকল্প পথ ছিলো না! উনি যদি ওই জনসভা ভেঙ্গে যাবার জবাব তাঁর কর্মী ও তাঁদের সমর্থক জনগনকে ব্যালটের মাধ্যমে দিতে বলতেন- তাহলে বর্তমানের তাদের যে অবস্থা তার থেকে কি ভালো হতো না? কারণ, তাদের অঙ্কটা গত পনেরো বছরের ভূ রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বাংলাদেশের বিনিয়োগের পাতাগুলো সামনে রেখে করাই কি শান্ত রাজনৈতিক মাথার কাজ ছিলো না?

 

তবে ওই কর্মসূচী যে তাদের ভুল ছিলো তা তারা দ্রুতই বুঝতে পেরেছে বলে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো প্রমান করে। যার সব থেকে বড় প্রমান তারা নির্বাচনের দিনে কোন সহিংসতা দিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করতে যায়নি। বরং নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তাদের নেতা রুহুল কবীর রিজভী এক বিবৃতিতে বলেন, যে সংসদ হতে যাচ্ছে এই সংসদ গ্রহন যোগ্যতা পাবে না। অর্থাৎ তিনি প্রকারন্তরে জানিয়ে দেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সংসদও প্রতিষ্ঠিত হবে। বিএনপিকে এগুলো মাথায় নিয়েই এগুতে হবে।

রুহুল কবীর রিজভীর এই বিবৃতির পর থেকে দেখা যায়, তারা তাদের কর্মসূচীতে আমুল পরিবর্তন আনে। অর্থাৎ তারা লিফলেট বিলি সহ নানান ধরনের গন সংযোগের কর্মসূচী দেয়। এ ধরনের কর্মসূচী দেয়ার অর্থই হলো, আবার শুরু’র থেকে শুরু করা।

 

যে কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচন বা কোন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে বড় পরাজয়ের পরে যদি আবার শুরুর থেকে শুরু করে সে সিদ্ধান্তকে অতিবড় শত্রুও সঠিক সিদ্ধান্ত বলবে।

 

লেখক: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও সারাক্ষনের সম্পাদক

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024