শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৫০ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৯)

  • Update Time : রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

আমার অন্ধ দাদা

আমার পিতার এক চাচা ছিলেন। নাম দানু মোল্লা। লোকে তাঁহাকে ধানু মোল্লা বলিয়া ডাকিত। অভি ছোট বয়সে চোখের কি অসুখ হয়। কোন এক বিদেশী গ্রাম্য কবিরাজ লঙ্কাবাটার সঙ্গে এক ঔষধ তাঁর চোখে লাগাইতে দিয়া যায়। এই ঔষধ চোখে লাগাইতেই তিনি সাত-আটজ দিন শুধু চিৎকার করিতে থাকেন। তারপর চোখের মণি দুইটি গলিয়া পড়িয়া যায়। অল্প বয়সে চোখ নষ্ট হইয়া যাওয়ার তিনি কোনো লেখাপড়া শিখিতে পারেন নাই। কিন্তু এই স্নেহপ্রবণ বৃদ্ধলোকটি ছিলেন গ্রামবাংলার কৃষ্টির জীবস্ত প্রতীক। কেচ্ছা, সমস্যা, শ্লোক এসব তো তিনি জানিতেনই, তাহা ছাড়া যতরকমের গ্রাম্যগান ও সুর তাঁর পেট ভরা ছিল। আমি আর আমার চাচাতো ভাই নেহা দুইজনে প্রতিযোগিতা করিয়া এই দাদার স্নেহ কুড়াইতাম। আজ আমার চোখে ভাসিতেছে জ্যোৎস্না-ফিনিক-ফোটা রাত। আমাদের উঠানে মাদুর বিছাইয়া দাদাকে সামনে লইয়া বসিয়া আছি। এ-বাড়ি ও-বাড়ি হইতে কয়েকজন চাষী আসিয়া সেই মাদুরের কোনায় বসিয়া গিয়াছে। দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় আমার চাচিরা, এ-বাড়ি ও-বাড়ির দু’একটি বউ, এধারে উত্তরঘরের দরজার কাছে পানের খিচা পাশে রাখিয়া পা ছড়াইয়া আমার মা বসিয়া আছেন।

আমরা দাদাকে বলিতেছি, “দাদা কেচ্ছা কও।” দাদা বলেন, “কেচ্ছা কি আমার মনে আছেরে, সেই কতকালের কথা?” আমরা ছাড়ি না, “না দাদা! কেচ্ছা বলিতেই হইবে। দাদা! তোমার পায়ে পড়ি একটা ভালো কেচ্ছা কও।” দাদারও ইচ্ছা কেচ্ছা বলিবার কিন্তু আমাদের দিয়া নানা অনুরোধ উপরোধ করাইয়া তিনি আমাদের কেচ্ছা শোনার আগ্রহ বাড়াইতেছেন। দাদা বলেন, “নারে আজ গলা ভালো নাই। তাছাড়া কেচ্ছা বলিতে আমার সঙ্গে গান ধরিবে কে?” আমি আর নেহা বলি, “আমরা ধরিব গান আপনার সঙ্গে।” ও-বাড়ির বুধাই মোল্লা বলেন, ‘ছ্যামড়ারা যহন দরছে, কন না একটা কিচ্ছা মোল্লার বেটা?”

দাদা তবু নারাজ। আমরা দু’ভাই দাদার পা জড়াইয়া ধরি, “দাদা! আজ কেচ্ছা না বলিলে ছাড়িবই না।” ও কোনা হইতে চাচিরা পানদানে করিয়া চুন ছাড়া পান সাজিয়া দাদাকে পাঠাইয়া দিয়া বলেন, “কন না চাচাজান! একটা কেচ্ছা কন। কতদিন কেচ্ছা শুনি না।”

দাদা তখন পানদান হইতে পানটি মুখে দিয়া আরম্ভ করিতেন।

কেচ্ছা কিচকিচানি কেমনে কেচ্ছা ছাড়ি,

এক ছিলুম তামুক দিলে কেচ্ছা কইতে পারি।

বড়দের মধ্য হইতে কেহ উত্তর করিত, “মোল্লার বেটা! আপনি তো তামাক খান না। এবার পান মুখে দিয়াই কেচ্ছা আরম্ভ করেন।”

তখন দাদা বলিতেন, “কোন কেচ্ছা শুনিবে?” কেউ বলিত, রুলান কন্যা-কেউ বলিত মধুমালা-কেউ বলিত আবদুল বাদশা। আমি আর নেহা বলিতাম, “দাদা। সবগুলি কেচ্ছাই শুনিব।” দাদা আমাদের বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরিয়া বলিতেন, “ওরে ভাই। সব কেচ্ছা একদিনে শুনিতে পারিবি না। আজ রাত্রে একটা কেচ্ছাই শোন।” আমরা বলিতাম, “তবে দাদা মধুমালার কেচ্ছাই বলেন।” দাদা কেচ্ছা আরম্ভ করিতেন।

কাঞ্চন নগরে ঘর, নামে রাজা দণ্ডধর, রাজার হাতিশালায় হাতি, ঘোড়াশালায় ঘোড়া, সভা ভরিয়া পাত্রমিত্র, মন্ত্রী, কোটাল, লোকজন সর্বদা গমগম করে। রাজার মালখানা ভরিয়া লাল ইয়াকুত জবরুত চুণিমণি ঝকমক করে। এত থাকিতেও রাজার সুখ নাই। রাজার কোনো বেটা পূত্র নাই। এইভাবে দাদা কেচ্ছার ইন্দ্রজাল ছড়াইয়া যাইতে লাগিলেন। হরিণ শিকারে যাইয়া মধুমালাকে স্বপ্নে দেখিয়া মদন কুমার যখন মায়ের

আঁচল ধরিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া গাহিতে লাগিল, ও আমি যাব মা ধন মধুমালার দেশে হে।

তখন আমাদের বালককণ্ঠের সঙ্গে দাদা আর গ্রামবাসীদের কণ্ঠ মিলিয়া কি যে এক সুরের উন্মাদনা সৃষ্টি করিতে লাগিল তাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। পদের শেষে মধুমালা কথাটিতে আসিয়া গানের সুর কি যে মধু ছড়াইয়া দিত তাহা যদি গাহিয়া শুনাইতে পারিতাম। মদন কুমার ষোলো ডিঙ্গা মধুকোষ সাজাইয়া মধুমালার দেশে রওয়ানা হইতেছে। তাহাকে বিদায় দিতে মদন কুমারের দুঃখিনী মায়ের জবানীতে দাদা যখন গান ধরিলেন ও আমার যায়রে মদন মধুমালার দেশে হে।

তখন আমার চাচিরা মায়েরা কাঁদিয়া বুক ভাসাইতেন। আমাদের এই পোড়া দেশে এমন কয়জন মা আছে, যার কোলের একটি ছেলেও মৃত্যুর কোলে না ঢলিয়া পড়িয়াছে। আজ মদন কুমারের বিদায়ের দৃশ্য স্মরণ করিয়া হয়তো তাহাদের আদরের ছেলেটিকে যেভাবে কাফনে সাজাইয়া একদিন চিরবিদায় দিতে হইয়াছিল তাহাই নতুন করিয়া তাঁহাদের মনে পড়িতেছিল। বস্তুত এইসব রূপকথার অন্তরালে যে মানবতাবোধ আর বাঙালিজীবনের যে নিত্য-নৈমিত্তিক সুখ-দুঃখের ছায়া লুকাইয়া রহিয়াছে তাহাই এই কাহিনীগুলিকে এতদিন গ্রাম-বাংলায় জীবন্ত করিয়া রাখিয়াছে। দিনে দিনে এই কাহিনীগুলিকে তাহারা নিজেদের জীবনে অভিনয় করিয়া ইহাদের মধ্যে নব নব রূপায়ণ আনিয়া দিয়াছে।

মদন কুমার যখন নানা পাহাড় পর্বত ডিঙ্গাইয়া, সাতসমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়া, কত দুঃখ-বিপদ উত্তীর্ণ হইয়া কাঞ্চন নগরে যাইয়া মধুমালাকে সঙ্গে লইয়া মায়ের কোলে ফিরিয়া আসিত, আমিও গানের আসর হইতে ঘরে যাইয়া মায়ের কোলটি ঘেঁষিয়া ঘুমাইয়া পড়িতাম। মনে হইত আমিই যেন সেই মদন কুমার। তারই মতো কত দেশ-বিদেশ পারাইয়া স্বপ্নের মধুমালাকে সঙ্গে লইয়া মায়ের কোলে ফিরিয়া আসিয়াছি। কত রাত্রে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া মধুমালাকে স্বপ্নে দেখিয়াছি।

এমনি করিয়া দাদার কাছে কতরকমের কেচ্ছাই না শুনিতাম। কেচ্ছা বলিবার সময় তিনি আঙুলে তুড়ি দিয়া, দুই হাত ঘুরাইয়া ফিরাইয়া, কণ্ঠস্বর কখনও বিলম্বিত লয়ে টানিয়া, কখনও…..

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024