শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৪ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২২)

  • Update Time : বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

আমার অন্ধ দাদা

দাদার অবস্থা আগে কিন্তু অত খারাপ ছিল না। দাদার আগেকার বাড়িতে তিনি নানারকম ফলের বাগান করিয়াছিলেন। বাগান করিতে করিতে আল্লার কাছে মোনাজাত করিতেন, আল্লা। আমার বাগানের ফলফুল পাখিপাখালিতে খাইয়া যাহা অবশিষ্ট থাকিবে তাহাই আমি খাইব। দাদার বাগানখানি নাকি হইয়াছিলও খুব সুন্দর। আম, জাম, লিচু, পেয়ারা, আরও কত রকমের ফলই না তাহাতে ধরিয়াছিল। দাদা গাছের ডালে ডালে হাঁড়ি বাঁধিয়া দিতেন। পাখিরা অনায়াসে সেখানে বাসা বাঁধিয়া ডিম পাড়িত-বাচ্চা উঠাইত। গাছের ফলফলারি খাইতে পাখিদিগকে বাধা দিতেন না। পরে নদীতে বাড়ি ভাঙিয়া এই বাগানটিকেও শেষ করিয়াছে। দাদা তো চোখে দেখিতেন না। এই বাগানে বসিয়া নানারকম পাখির ডাক শুনিতেন। তিনি নিজেও পাখির ডাকের সুন্দর নকল করিতে পারিতেন।

একবার দাদার কলেরা হইল। আমার পিতা ডাক্তার আনিয়া দাদার ভালোমতো চিকিৎসা করাইলেন। দাদার অসুস্থ হওয়ার মধ্যে এই কলেরা রোগে নেহার বিমাতা ও একটি ভাই ও বোন মারা গেল। এই খবর দাদাকে জানানো হইল না। নেহার বিমাতা দাদাকে বড়ই যত্ন করিতেন। তাঁর ছেলে রোকন আর মেয়ে কুটিকে দাদা কোলেপিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছিলেন। আমাদেরই মতন তিনি তাহাদিগকে ভালোবাসিতেন। দাদা অসুখ হইতে ভালো হইয়া উঠিয়া আমাদের সঙ্গে খাইতে লাগিলেন। খাইতে বসিয়া ও-বাড়ির বড় বউর কথা জিজ্ঞাসা করেন, ছোট ছেলেমেয়ে দুটির কথা জিজ্ঞাসা করেন। মা আড়ালে চোখের পানি মুছিয়া বলিতেন, “বড় বউ বাপের বাড়ি গিয়াছে। ছেলেমেয়ে দুইটিও সঙ্গে গিয়াছে।” গ্রামের লোকদেরও বলিয়া দেওয়া হইয়াছিল দাদাকে যেন বড় বউর মৃত্যুর কথা জানানো না হয়। হঠাৎ একদিন বড় বউর বাপের বাড়ির গ্রাম হইতে একটি লোক আসিয়া দাদার সঙ্গে আলাপ করিতে থাকে। দাদা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা, বড় বউ আমাকে এত আদরযত্ন করিত। আমার এত বড় অসুখ জানিয়াও সে কোন প্রাণে বাপের বাড়ি যাইয়া বসিয়া আছে! ছেলেমেয়ে দুইটিকেও লইয়া গিয়াছে। তাদের না দেখিয়া তো আমি বাঁচি না!”

লোকটি বলিয়া ফেলিল, “তারা কি আছে? কলেরা হইয়া তাহারা সবাই মরিয়া গিয়াছে।” চিৎকার করিয়া দাদা মাটিতে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন। তারপর ছয়-সাতদিন প্রায় অনাহারে। সকালে দুপুরে কেমন করিয়া দাদা যেন লাঠিখানা ভর দিয়া যাইয়া তাহাদের কবরের পাশে বসিয়া থাকিতেন। আমি আর নেহা তাঁকে টানিয়া আনিতে কত চেষ্টা করিতাম-দাদা আসিতেন না।

এই শোক তাপে আর কলেরার আক্রমণে দাদার মতিভ্রম হইয়া পড়িল। আগের সেই গল্প কেচ্ছা সমস্ত ভুলিয়া গেলেন। গলার সেই সুন্দর কণ্ঠস্বরও হারাইয়া ফেলিলেন। এই হৃতসর্বস্ব বৃদ্ধকে তখন কে আর আদর করে। পথ দিয়া চলিতে গ্রামের বউঝিরা আর তেমন আগ্রহ করিয়া তাঁহাকে ডাকিয়া লয় না। মাঠ দিয়া যাইতে চাষিরা আর তাঁর লাঠি ধরিয়া টানে না। আমাদের উঠানে আর সেই রূপকথার রাজা তাঁর কাহিনীর ইন্দ্রজাল রচনা করিয়া গ্রামবাসীদের মুগ্ধ করিতে পারেন না। আজ জরায় জীর্ণ অসহায় এই বৃদ্ধটিকে কেহই আসিয়া জিজ্ঞাসা করে না, মোল্লার বেটা কেমন আছেন?

আমাদেরও তখন বয়স হইয়াছে। পাঠশালায় স্কুলে যাইয়া নানারকমের আকর্ষণের সন্ধান পাইয়াছি। খেলার মাঠ আমাকে ডাকে, নদীর পানি আমাকে ডাকে তার অতলে সাঁতার কাটিতে। দাদাকে সঙ্গ দিবার সময়ও ধীরে ধীরে সঙ্কীর্ণ হইয়া আসিতে লাগিল।

দাদা এক একা বসিয়া থাকিতেন। মাঝে মাঝে পুরাতন গানের দুই-এক কলি গাহিয়া মনে করিতে চেষ্টা করিতেন। খাইবার সময় হইলে মা তাঁকে খাবার দিয়া আসিতেন। মায়ের সংসারে বহু কাজ। আমরা তখন চার ভাইবোন জন্মিয়াছি। আমাদের দেখাশুনা করিয়া সাংসারিক নানারকমের কাজকর্ম করিয়া দাদাকে সেবা-যত্ন করিবার অথবা ভালোমতো তাঁর সঙ্গে বসিয়া দু’চারটি কথা বলিবার মা’র অবসরও ছিল না। মায়ের রান্না দাদার ভালো লাগিত না। মা তরকারিতে ঝাল কম দেন। প্রতিবাসীরা কেহ দাদার কাছে আসিলে দাদা বড় বউর সঙ্গে মায়ের রান্নার তুলনা করিতেন। তা ছাড়া তাঁর স্মৃতিশক্তি ধীরে ধীরে লোপ পাইতেছিল। তখন তাঁহার বয়স প্রায় ৮০ বৎসরের কাছে। এইমাত্র মা খাওয়াইয়া দিয়া গেলেন। পরমুহূর্তে কেহ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, “না তো, আজ বউ আমাকে ভাত দেয় নাই।” মা খুব চটিয়া যাইতেন। ইহাতে মায়ের আত্ম-অহঙ্কারে বাধিত।

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024