রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৬ পূর্বাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২৩)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

আমার অন্ধ দাদা

আজ এই কাহিনী লিখিতে লিখিতে নিজের অনাগত কালের কথাই ভাবিতেছি। যখন আর লিখিতে পারিব না, আর লোকের মনোরঞ্জন করিতে পারিব না, তখন সেই অকৃতজ্ঞ দিনগুলির কথা ভাবিয়া শিহরিয়া উঠিতেছি।

এইভাবে এ-বাড়ি ও-বাড়ি খাইয়া দাদার পেটের অসুখ হইল। ঘরের এক পাশে একটি গর্ত করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। সেখানেই তিনি পায়খানা প্রস্রাব করিতেন। দুপুরবেলা তাহা মাটির চাড়ায় করিয়া মাথায় করিয়া সামনের মাঠে ফেলিয়া দিয়া আসিতেন। পাড়ার ছেলেরা ছড়া কাটিয়া তাড়া করিত। আমি বাড়ি থাকিলে এরূপ হইতে দিতাম না।

একদিন তিনি বিকালবেলা গাঙের ঘাটে একলা নাইতে নামিয়াছেন। হঠাৎ পরন কাপড়ে পা জড়াইয়া পানিতে পড়িয়া যান। আর উঠিতে পারেন নাই। পানিতে পড়িয়া কত যেন লোকজনকে ডাকিয়াছিলেন।

অবেলায় তখন কেহ গাঙের ঘাটে ছিল না। সন্ধ্যা হইয়া আসিল, তখনও তিনি বাড়ি ফিরিলেন না। চারিদিকে খোঁজ পড়িল, এ-বাড়ি সে-বাড়ি কোথাও তিনি যান নাই। আমার চাচারা জাল লইয়া গাঙের ঘাটে ফেলিলেন। দাদার মৃতদেহ জালে আটকাইয়া আসিল। আমার পিতা, চাচারা, মা সকলেই দাদার জন্য উহু আহা করিলেন কিন্তু কেহই ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিলেন না। যে-ব্যক্তি সারাজীবন ভরিয়া কেচ্ছা-কাহিনীর মাধ্যমে পরের কল্পিত কথা লইয়া সুখে দুঃখে আজীবন হাসিয়াছেন কাঁদিয়াছেন আজ তাঁহার জন্য কেহই এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলিল না। আমি একান্তভাবে আমার দাদার কথা যখন ভাবি তখন আত্মধিক্কারে সমস্ত মন দলিত মথিত হইতে চায়। যাঁর কথা-কাহিনীর ভিতর দিয়া বাড়িয়া উঠিয়াছিলাম, তাঁকে

কেন একদিনের জন্যও সেবা করিলাম না। কেন তাঁর ময়লা কাঁথা কাপড় একদিনের জন্যও ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া দিলাম না। হয়তো তখন বুঝিবার বয়স হয় নাই। হয়তোবা সেই শিশুজীবনে যতটুকু মনে আসিয়াছিল তাহাই তাঁর জন্য করিয়াছিলাম কিন্তু তবু মনে আজ কিছুতেই প্রবোধ মানিতেছে না। আমার পিতা লোকজন ডাকিয়া শানশওকাতমতো তাঁর দাফন-কাফন করিয়াছিলেন। তাঁহার কবরে প্রথম মাটি দেওয়ার সময় তিনি বলিয়াছিলেন, “আমার মুরুব্বিদের মধ্যে এই একজন একটু আগেও জীবিত ছিলেন। আজ তাঁর শেষকৃত্য করিয়া যাই। মিঞা সাহেবরা। আমার চাচা জ্ঞানে অজ্ঞানে তোমাদের কারও কাছে যদি কোনো অপরাধ করিয়া থাকেন তোমরা মাফ করিয়া দাও।” গ্রামের লোকেরা বলিল, “তিনি কারও কাছে কোনো অপরাধ করিয়া যান নাই-কোনোদিন কারও কোনো ক্ষতি করেন নাই।”

আমার কবিজীবনের প্রথম উন্মেষ হইয়াছিল এই দাদার গল্প, গান ও কাহিনীর ভিতর দিয়া। সেই ছোটবেলায়ই মাঝে মাঝে আমাকে গানে পাইত। নিজে মনোক্তি করিয়া ইনাইয়া বিনাইয়া গান গাহিয়া যাইতাম। দাদা একদিন একজনকে বলিতেছিলেন, “পাগলা গানের মধ্যে কি যে বলে কেউ শোনে না। আমি কিন্তু শুনি মনোযোগ দিয়া ওর গান।” কি অন্তর্দৃষ্টির বলেই না আমার রচক-জীবনের প্রথম আকুলি-বিকুলি তিনি ধরিতে পারিয়াছিলেন।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024