বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমের অনেক ব্যবহারকারী ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে কিছুদিন ধরে যে প্রচারণা চালাচ্ছেন তাতে সংহতি প্রকাশ করেছেন দেশটির অন্যতম বিরোধী দল বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। এরপরই প্রশ্ন উঠেছে বিএনপি দলীয়ভাবেই ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন’ প্রচারণায় জড়িয়ে পড়ল কি না।
একজন বিশ্লেষক অবশ্য বলছেন বিএনপি দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এটি না করলেও দলটির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার এ ধরনের সংহতি প্রকাশ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ভারতের বিরুদ্ধে বিএনপির যে ক্ষোভ’ তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন তিনি।
তবে বিএনপির অন্য আরও কয়েকজন নেতার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
যদিও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে সরব প্রচারণা চালাচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে চীনের পরে ভারত থেকেই সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয়ে থাকে, যা মোট আমদানির প্রায় বিশ শতাংশ। এর মধ্যে পেঁয়াজের মতো জরুরি অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরতা আছে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের।
অন্যদিকে বাংলাদেশে কয়েক দফায় ক্ষমতায় থাকা বিএনপির রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতার ইতিহাস আছে। কখনো কখনো ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে দলটির সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা দেখা গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্কের অবনতি হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
সব শেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কিছুদিন ভারতের বিষয়ে খুব একটা মুখ না খুললেও ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ভারত নিয়ে মন্তব্য করতে শুরু করেন দলটির নেতারা। আর নির্বাচনের পর থেকে প্রকাশ্যেই ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।
কারণ তারা মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপ উপেক্ষা করে বিএনপিকে ছাড়াই যে নির্বাচনটি আওয়ামী লীগ করতে পারলো তার পেছনে ছিল ভারতীয় সমর্থন।
এখানে বলে রাখা ভালো যে ২০১৪ সালের মে মাসে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকে নানা ঘটনায় বিএনপির নেতাদের মধ্যে এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছে যে ভারত বাংলাদেশে শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে স্বস্তিবোধ করছে।
দলটির শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে এমন ‘অবস্থান’ নেওয়ার অভিযোগ করে এর সমালোচনা করেছেন প্রকাশ্যেই।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী মোদী। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ভারতীয় পণ্য বর্জন ও বিএনপির সংহতি
বাংলাদেশে গত কিছুদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে ক্যাম্পেইন করছিলো সরকার বিরোধী নানা গ্রুপ ও ব্যক্তি। বিএনপির সাথে আন্দোলনে থাকা কয়েকটি দলের ব্যানারেও এমন ক্যাম্পেইন পরিচালিত হতে দেখা গেছে ঢাকায়।
কিন্তু এতদিন বিএনপি দলীয়ভাবে বা তাদের সিনিয়র নেতারা এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনও অবস্থান নেননি।
শেষ পর্যন্ত বুধবার দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও দলটির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী তার নিজের গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ প্রচারণার প্রতি সংহতি জানান।
এর আগে তিনি বলেন, “সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে ঢেউ দৃশ্যমান হয়েছে, তাতে মনে হয় দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে।”
পরে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন বাংলাদেশে গত নির্বাচনে ভারতের ভূমিকার কারণে ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে যে সামাজিক আন্দোলন তৈরি হয়েছে তাতেই সংহতি প্রকাশ করেছেন তিনি।
কিন্তু এটি বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত বা অবস্থান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটি দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। এটি গত নির্বাচনে ভারতীয় নীতি নির্ধারক ও কূটনীতিকরা যেভাবে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থা নিয়ে তার বিরুদ্ধে একটি সামাজিক প্রতিবাদে অংশ নেওয়া।”
বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই প্রচারণা দৃশ্যমান হয় মূলত সাতই জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর থেকে।
ওই নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করলেও ভারতের বক্তব্য ছিল “নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় ও বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে কারা দেশ পরিচালনা করবে।”
এরপরই ধারণা সৃষ্টি হয় যে ভারতের অবস্থানের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপ উপেক্ষা করে বিএনপিবিহীন নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও আবারো ক্ষমতায় আসতে পেরেছে আওয়ামী লীগ।
ওই নির্বাচনের পরপরই বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা গণঅধিকার পরিষদ নেতা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ঢাকায় একাধিক রাজনৈতিক সভায় ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেছেন।
মি. নুর তখন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “ভারত যদি একপাক্ষিক সম্পর্ক মেইনটেইন করে তাহলে তো আমাদের অ্যান্টি ইন্ডিয়ান হওয়া ছাড়া কোনা উপায় নাই … এই সরকারের যেহেতু খুঁটির জোরটা হচ্ছে ভারত কাজেই সেই ভারতের বিরুদ্ধে জনগণকে আরও সংগঠিত করে একটা মুভমেন্ট দরকার যেটা মালদ্বীপের ক্ষেত্রে হয়েছে।”
একই সঙ্গে দেশের বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের সমালোচক হিসেবে পরিচিত অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরাও একই ধরনের প্রচারণা শুরু করেন।
বুধবার নিজের গায়ের চাদর ফেলে দিয়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশের পাশাপাশি দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, তাদের আপত্তি ভারতীয় শাসকদের পলিসি বা নীতি নিয়ে।
“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-সহ সব জায়গা এখন ভারত আউট ক্যাম্পেইনে উত্তাল। ভারতীয় পণ্য বর্জন করে দেশের জনগণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে। রাজধানীতে মিছিল সমাবেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হচ্ছে,” বলছিলেন তিনি।
পরে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জনগণ মনে করে ভারতীয় নীতিনির্ধারক ও কূটনীতিকদের কারণেই বাংলাদেশের মানুষ আবারো ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ কারণেই মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এবং সে ক্ষোভ থেকে পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হয়েছে”।
দিল্লির সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাও (ডানে)। ১৯৯৫ সাল।
বিএনপির টেস্ট কেস?
বাংলাদেশে অনেকে মনে করেন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি নেতাদের মধ্যে এই উপলব্ধি এসেছে যে ‘পাবলিক সেন্টিমেন্ট ভারতের পক্ষে নয় এবং বিএনপিরও আর ভারতকে তোয়াজ করার কিছু নেই।’
সে কারণেই দলটির নেতাদের অনেকে ভারত বিরোধিতাকে প্রাধান্য দিয়েই বক্তৃতা বিবৃতি দিতে শুরু করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন নির্বাচনের সময় থেকেই বিএনপি ধরেই নিয়েছে যে ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিচ্ছে।
“এ কারণেই তারা এখন ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহতির মাধ্যমে পাবলিক সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগাতে চাইছে। এটি হয়তো তাদের জন্য একটি টেস্ট কেসও হতে পারে। তারা হয়তো দেখতে চায় জনগণ কীভাবে নেয় আর ভারতই বা কেমন রেসপন্স করে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে আগেও এক সময় বিএনপি ভারত বিরোধিতার জন্য পরিচিত ছিল। মাঝে সেই পরিচিতি কাটিয়ে ওঠে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টাও দেখা গেছে তাদের মধ্যে।
“কিন্তু নির্বাচনে ভারতের অবস্থান সবার কাছে পরিষ্কার এবং তা বিএনপির পক্ষে যায়নি। ফলে তারাও এখন মানুষের সেন্টিমেন্টকে আমলে নিয়ে ভারত বিরোধী আওয়াজ জোরালো করতে চাইছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
রুহুল কবির রিজভী অবশ্য বলছেন যে তাদের আপত্তি দেশ হিসেবে ভারত বা সে দেশের জনগণকে নিয়ে নয়।
“আমরা বলছি যে ভারতীয় নীতি নির্ধারক ও কূটনীতিকরা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে একটি বিশেষ দলের পক্ষ নিয়েছে।”
“সে কারণেই জনমনে ভারত বিরোধিতা জোরালো হয়েছে ও পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply