শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৭ পূর্বাহ্ন

প্রকৃতিবিদের কাহিনী (কাহিনী-৩৭)

  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

পিওতর মান্তেইফেল

বন্দিদশায় ও স্বাভাবিক অবস্থায় পাখিদের বংশবৃদ্ধি

মস্কোর চিড়িয়াখানায় সবুজ সবুজ, ঝিলমিলে অস্ট্রেলীয় টিয়া পাখি আছে প্রচুর, থাকে তারা জালি তার ঘেরা বড়ো বড়ো খাঁচায়। ছিমছাম চণ্ডল এই পাখিগুলো তাদের উচ্ছল কিচির-মিচিরে বাতাস ভরে তোলে।

স্বদেশে, অস্ট্রেলিয়ায় তারা বাচ্চা পাড়ে গাছের কোটরে, আমাদের দেশের ফিঞ্চ বা গ্রাশ পাখির মতো কখনোই খোলা বাসা বানায় না। সামনে ঢোকার ফুটো রেখে কাঠের ছোটো ছোটো ঢাকা বাক্স টাঙিয়ে দিলে চিড়িয়াখানাতেও এই অস্ট্রেলীয় বন্দীরা ছোটো ছোটো শাদা ডিম দিতে থাকে কেবল তাতেই।

শুধু এই ঢাকা বাক্স আর কৃত্রিম কোটর ছাড়া অন্য কোনো বাসাতেই বাচ্চা দেয় নি টিয়ারা।

একবার, ডিম পাড়ার ঠিক মরশুমের সময় আমরা কাঠের বাসা আর কৃত্রিম কোটরগুলো সরিয়ে নিই, ভেবেছিলাম, ডিম পাড়ার আসন্ন বেগ তাতে আটকাবে না, খাঁচার মেঝেতেই ডিম দেবে। কিন্তু সেটা হল না। কাঠের বাসাগুলো সরিয়ে নিতেই জুড়ি বাঁধা টিয়াগুলোর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, বন্ধ হল ডিম পাড়া। কাঠের বাক্সগুলো ফের টাঙাতে দ্বিতীয় বার সজীবতা শুরু হল, জুড়িতে জুড়িতে ফের ভাগ হয়ে গেল টিয়ারা, ডিম পাড়ল, তা দিল, আর ১৬ দিন পর তা থেকে ফুটে বেরল ন্যাংটা ন্যাংটা বাচ্চা, মা-বাপ দু’জনেই তাদের খাওয়াতে লাগল তাদের উদ্‌দ্গার দিয়ে।

একজন কিশোর জীববিদ জিজ্ঞেস করলে:

‘চিড়িয়াখানায় অধিকাংশ পাখি যে বাচ্চা দেয় না, সে কি এইজন্যে নয় যে প্রকৃতিতে হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন পাখি যে পরিস্থিতিতে বাসা বে’ধে এসেছে তা এখানে নেই? পরিবেশের সুনির্দিষ্ট একটা পরিস্থিতিতে জন্মগত প্রতিক্রিয়া গড়ে উঠেছে ব’লেই কি, ই. প. পাভলভ যাকে বলেছেন “অনপেক্ষ প্রতিবর্ত”?’

বললাম, ‘অনুমান করার চেষ্টা না করে, যেসব পাখি বছরের পর বছর চিড়িয়াখানায় থাকলেও কিছুতেই ডিম দিচ্ছে না, তাদের জন্যে বিশেষ পরিস্থিতি গড়ে দেওয়া যাক।’

কাজের ধুম পড়ে গেল: পুকুরের পাড়ে ছেলেরা পাথর এনে ঢিপির মতো বানালে, তাতে রইল খোলা গুহা, নিচে খোঁদল। নতুন এলাকার ঝিলে তারা সারিসিনো’র পুকুর থেকে লম্বা লম্বা হোগলার বহু, চাপড়া অল্প জলে বসিয়ে দিলে। বুলফিন্ড পাখির ডেরায় বসানো হল বেশ উচু, ঝাঁকড়া ফার গাছ, জ্বলজ্বলে সবুজ নতুন শাখা তার তখনো বেরয় নি।

চিড়িয়াখানায় যেসব পাখি ডিম দেয় না, বন্য অবস্থায় তারা যেসব প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে বাসা বাঁধত, চিড়িয়াখানার রূপান্তরিত অংশগুলো হল তার অনুরূপ। সবাই অধীর হয়ে রইলাম বসন্তের মরশুমের জন্যে। অবশেষে মধুঋতু। বড়ো হয়ে উঠতে লাগল দিন, আকাশ গুঞ্জরিত হয়ে উঠল ভরত পাখির গানে। দক্ষিণ থেকে উড়ে আসতে শুরু করল পাখির সজীব ঝাঁক। শহরের ওপর দিয়ে অনেক উচুতে ত্রিভুজের আকারে উড়ে যেতে থাকল হংস-বলাকার দল আর রাত্রে শোনা গেল তুন্দ্রা-গামী, যাযাবর স্নাইপ পাখির অদ্ভুত, কিন্তু সুরেলা শিস।

চিড়িয়াখানাতেও চঞ্চল হয়ে উঠল শ্বেতগণ্ড হাঁসেরা। কয়েক বছর আগে এদের আনা হয়েছিল নরওয়ের উপকূল থেকে, কিন্তু চিড়িয়াখানায় তারপর একবারও বাচ্চা দেয় নি। এখন তারা হয়ে উঠল উত্তরমুখী, ছুটে জল থেকে উড়ে যাবার চেষ্টা করল তারা, কিন্তু পাশকে ভঙ্গিতে খানিকটা উড়ে অসহায়ের মতো ফের নেমে এল পুকুরে। উড়তে পারে নি, কারণ তাদের ডানার ডগার পালক ছিল কাটা।

দু’সপ্তাহ পরে জলচর পাখিদের উত্তরে উড়ে যাবার মরশুম শেষ হল, শান্ত হয়ে এল শ্বেতগঞ্জ হাঁসেরাও। তাদের মনে হতে লাগল যেন কোনো নতুন জায়গায় উড়ে এসেছে। কেবল এর পরেই তারা জুড়ি বে’ধে বে’ধে পাথুরে ঢিপিটায় বাসা বাঁধার মতো জুৎসই জায়গা খুঁজে বেড়াল। যেসব জায়গায় কোনো একটা মাদী বাসা বাঁধা নিয়ে বাস্ত সেখানে তার মর্দা অন্য কোনো মর্দাকে ঢুকতে দিত না। অমন ভীরু, চুপচাপ হাঁসগুলো হয়ে উঠল দজ্জাল, খে’কুরে, শান্ত হল কেবল সবাই বাসা পাবার পর।

শেষ পর্যন্ত ডিমে তা দিতে বসল মাদীরা আর মর্দাগুলো তাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে অন্য পাখির হামলা থেকে নির্ভয়ে রক্ষা করতে লাগল তাদের।

২৮-২৯ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বেরুল, জলে দেখা গেল জোড়ায় জোড়ায় শ্বেতগণ্ড হাঁস, তাদের সঙ্গে ৪-৫টি করে সবজেটে ছানা।

চিড়িয়াখানার ঝিলে বসানো চাপড়াগুলো থেকে যখন হোগলা গজাল এবং সেখানে খুঁড়ে রাখা গর্তগুলো সমেত ভেতর দিকটা একেবারে ঢাকা পড়ে গেল, তখন এমন আরো কতকগুলো জাতের হাঁসের নজর পড়ল সেসব জায়গায়, যারা চিড়িয়াখানায় আগে কখনো বাসা বাঁধত না। জলে বুক দেবে, যেন সবার অলক্ষ্যে চুপিসাড়ে তারা ঢুকে পড়ত হোগলার ভেতরে, পেট থেকে পালক ছি’ড়ে তা বিছাত গর্তগুলোয়, তারপর ডিম দিতে লাগল।

তা দেওয়া শুরু হবার ২৪-২৮ দিনের মধ্যে চিড়িয়াখানার ‘ঝিল’ ভরে গেল নানা জাতের হাঁসের বাচ্চায়।

ঝাঁকড়া ফার গাছটাও অবহেলিত রইল না: কাঠি, বিচালি আর সেখানকার বাসিন্দা পাখিদের পালক দিয়ে নিপুণভাবে তাতে বাসা বানালে বুলফিন্ড পাখিগুলো।

প্রকৃতিতে কী কী পরিস্থিতিতে পাখিদের বংশবৃদ্ধি হয়, তার অধ্যয়ন চালিয়ে আমরা চিড়িয়াখানায় কৃত্রিমভাবে তা গড়ে নিই। এইভাবে ফিল্ড, নাইটিঙ্গেল, তিতির, উড-গ্রাউজ প্রভৃতি বহু, জাতের পাখিকে বাচ্চা দিতে বাধ্য করেছি আমরা। শুধু ঈগল প্রভৃতি যেসব শিকারী পাখি প্রকৃতিতে বাসা বাঁধে উচু উচু গাছে, চিড়িয়াখানায় তাদের জন্যে উপযুক্ত পরিস্থিতি গড়ে তোলা যায় নি। তাছাড়া ওড়ার সুযোগ সীমিত থাকায় তাদের ব্যায়াম হত না, তাতে দুর্বল হয়ে পড়ে পেশী, ভেতরকার সমস্ত দেহযন্ত্রের কাজই বিঘ্নিত হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে বেশি রকম ডানা- কাটা লাল হাঁস এবং অন্যান্য যেসব পাখি ওড়ার সুযোগ পায় না, চিড়িয়াখানায় তাদের বাচ্চা হয় না।

প্রকৃতিতে এক-একটা জাতের পাখির পক্ষে বাসা বাঁধার যা বৈশিষ্টা, কোনো পাখিকে তা লক্ষ্মন করতে দেখা গেছে কদাচিৎ।

তাই, মরুভূমিতে একবার মাটিতে ঈগল পাখির বাসা দেখে আমার অবাক লেগেছিল, এরা সাধারণত বাসা বাঁধে উচু উচু গাছে। রাশি রাশি হাড় আর ডাল দিয়ে বাসাটা তৈরি। সেটা খানিকটা তুলতে দেখলাম তলে রয়েছে দেবে খাওরা একটা সাকসাউল গাছ। তখন বুঝলাম, এ ঈগলও তার জাতের অভ্যাস (প্রতিবর্ত ক্রিয়া) বদলায় নি। দেখে মনে হচ্ছে, প্রথমটা সে বাসা বানিয়েছিল গাছেই। সেখানে সে বাচ্চা ফুটিয়েছে বহু বছর ধ’রে আর প্রতিবারই নতুন নতুন মাল-মসলা দিয়ে বাসা সম্পূর্ণ করেছে। শেষে বাসাটা এত ভারি হয়ে ওঠে যে মরুভূমির এই ঠুনকো গাছটা ভেঙে পড়ে আর বাসা সমেত ঈগলও নেমে আসে মাটিতে।

বাসা বাঁধার প্রত্যক্ষ ও বাধ্যতামূলক পরিস্থিতি ছাড়াও আরো কতকগুলো শর্তের ওপরেও বংশবৃদ্ধি নির্ভর করে। যেমন, দাঁড়কাকেরা বাসা বাঁধে সাধারণত পরস্পর খুব কাছাকাছি বড়ো একটা বসতি পেতে।

চিড়িয়াখানায় তারা একবারও ডিম পাড়ে নি, কেননা, মনে হয়, বংশবৃদ্ধির তাগিদ বোধ করার জন্যে বাসা ছাড়াও তাদের আরো দরকার চে’চামেচি, ডাকাডাকি, পাখার ঝটপট, স্বজাতির নৈকট্য। স্যান্ড-মার্টিন, গোলাপী স্টার্লিঙ্গ প্রভৃতি যেসব পাখি একসঙ্গে বসতি পেতে বাসা বাঁধে, তাদের বেলাতেও এটা প্রয়োজন।

প্রকৃতিতে একলষে’ড়ে পাখিরা সাধারণত খাবার সংগ্রহ করে বাসার আশেপাশের জায়গা থেকে, তাই পরস্পর কাছাকাছি বাসা বাঁধে না তারা। প্রয়োজনীয় দূরত্বটা তারা স্থির করে নেয় নিজেরাই; সচরাচর এ নিয়ে চলে জোড়ায় জোড়ায় ঝগড়া, প্রত্যেক জুড়িই রাখে নিজেদের আলাদা আহার-ক্ষেত্র।

একসঙ্গে বসতি পেতে যারা থাকে: দাঁড়কাক, সিন্ধু-চিল, সোঅলো প্রভৃতিরা খাবারের জন্যে বহুদূর উড়ে যায়, বাসার কাছাকাছি খাদ্য-সংস্থানের ওপর নির্ভর করে না। শিকারী পাখিদেরও শিকারের এলাকা অনেক বড়ো, কেননা ছোটো এলাকায় শিকার মেলা কঠিন।

বিভিন্ন উপকারী পাখির বাসা বাঁধার শর্ত’ অনুধাবন করা দরকার, সংরক্ষণ করা উচিত তাদের উপযোগী জায়গাগুলো, বসন্তে কেবল কাঠের বাসা টাঙিয়ে রাখলেই যথেষ্ট হয় না, কেননা তাতে ঠাঁই নেয় কেবল অল্প কয়েকটা জাতের কোটরবাসী পাখি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024