শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৭ অপরাহ্ন

বিশ্ব কূটনীতিতে পরিবর্তিত হাওয়া 

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮.৩৫ এএম

স্বদেশ রায়

কোভিড ও কোভিড পরবর্তী সময়ে পৃথিবী যে উত্তেজনাকর কূটনীতির মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো সেখান থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা সব পক্ষেরই দেখা যাচ্ছে।

কোভিড পরবর্তী সময়ে চায়না উলফ ওরিয়র ডিপ্লোম্যাসি গ্রহন করেছিলো। ইতোমধ্যে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এর একজন কলামিস্ট লিখেছেন, চায়নার সে সব উলফ ওরিয়ররা কি আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টে অবস্থান করছেন?

তিনি একটু তীর্যক মন্তব্য করেছেন চায়নার ওই ডিপ্লোম্যাসির প্রতি। তবে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখলে বলা যায়,  চায়না যে প্রয়োজনে তাদের উলফ ওরিয়র ডিপ্লোম্যাসি শুরু করেছিলো তার প্রয়োজনীয়তা অনেকটা এ মুহূর্তে ফুরিয়ে গেছে। কারণ, ওই সময়ে চায়নার প্রয়োজন ছিলো  কোভিড উত্তর পরিবর্তিত পৃথিবীতে তারা যেন তাদের অবস্থান না হারায়।

এখন বলা যেতে পারে, চায়নার অর্থনীতির আকার ও সামরিক শক্তি অনুযায়ী তাদের এ মুহূর্তে যে অবস্থান প্রয়োজন তা তারা অনেকখানিই অর্জন করেছে। বরং আর্থিক বিনিয়োগ তারা দেশে দেশে যেভাবে বাড়িয়েছে, তাতে তাদের এখন কূটনীতির অন্যতম লক্ষ্য অনেকগুলো সমস্যা জড়িত দেশ থেকে পে- ব্যাক।

যেমন শ্রীলংকায় নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে কোন শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মেজরটি অংশ ক্ষমতার বাইরে। এমনি দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও অনান্য এলাকায় যেখানে যেখানে দুর্বল সরকার সেখানে চায়নার মূল লক্ষ্য তাদের বিনিয়োগ-এর লভ্যাংশ ও বিনিয়োগের অর্থ ফেরত নেয়া।

অন্যদিকে, সাউথ চায়না সি বাস্তবে চায়নার একটি বড় সমস্যা। তেমনি সমস্যা তাইওয়ান। এই দুই ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে চায়নাকে বেশ শান্ত মনে হচ্ছে।

এই শান্ত মনে হবার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেমন যে দেশগুলোর সঙ্গে চায়নার সাউথ চায়না সি নিয়ে সমস্যা ও তাদের অতি নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোতে জনমত বদলে গেছে। সেখানে অনেক দেশে আগে আমেরিকার প্রতি জনসমর্থন বেশি ছিলো,  আমেরিকান গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্সের জনমত জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে তা কিছুটা কমে গেছে। এবং চায়নার প্রতি জনসমর্থন বেড়েছে। এই জনসমর্থন চায়নাকে সামরিকভাবে লাভবান না করলেও বানিজ্যিকভাবে লাভবান করবে। বাস্তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এ দেশগুলোকে চায়না তার ন্যাচারাল বিজনেস ভূমি হিসেবে রাখতে চায়।  এর পরে তার পরবর্তী ধাপ নিয়ে চিন্তা। স্বাভাবিকভাবে এই জনসমর্থন তাদের ন্যাচারাল বিজনেস ভূমি তৈরির ক্ষেত্রে অন্যতম সূচক।

অন্যদিকে এ মুহূর্তে এশিয়ায় চায়নার সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্ধি ভারত। জাপান তার পরে। জাপানের সঙ্গে ভারতের বড় পার্থক্য হলো,  ভারত এ সময়ে পৃথিবীর অন্যতমবড় বাজার। পৃথিবীর সাত ভাগের প্রায় দেড়ভাগ মানুষই ভারতের এই বাজারের ক্রেতা। তাছাড়া এই বড় বাজারটি চায়নার সব থেকে নিকটতম বাজার। অনেক দক্ষিণ পূর্ব এশিয় দেশের থেকে ভারত তার কাছের দেশ। তাছাড়া এ মূহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর দেশ। তাই কোভিড ও কোভিড পরবর্তী সময়ে চায়না যে “ভারত নীতি”  নিয়েছিলো সেখান থেকে সরে এসে সে স্বাভাবিকই ভারতের বাজারের কথা চিন্তা করে এগুবে। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার অনান্য দেশে যেহেতু চায়নার বাজার অস্থিতিশীলতায় কবলে পড়ে গেছে -সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার এই স্থিতিশীল ও পৃথিবীর অন্যতম বড় বাজারকে তারা কোন মতেই হাত ছাড়া করবে না।

ইতোমধ্যে চায়নার সরকারি মূখপত্র গ্লোবাল টাইমস তাদের সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়তে ভারত ও চায়নার বানিজ্যিক যোগাযোগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে লিখেছে। ভারতের থিঙ্ক ট্যাংকদের অনেকে অনেকটা এমনই লিখছেন। অন্যদিকে এমাসেই দুই দেশ তাদের ভেতরকার মূল সমস্যা যে সীমান্ত সমস্যা তার ছয়টি স্থানের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ চারটি সীমান্তের বিষয়টি মিটিয়ে নিয়েছে।  ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর তার টুইটে প্রকাশ করেছেন, দুই দেশের সীমান্ত সমস্যার ৭৫% সমাধান হয়ে গেছে।

এর পাশাপাশি এবার আমেরিকায় অনুষ্ঠিত কোয়াড সামিটের ভাষা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, কোয়াড়ের মূল উদ্দেশ্য ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকাকে শান্তিপূর্ণ রাখা। সেই লক্ষ্যে আমেরিকা ও তার মিত্ররা কাজ করবে। তারা চায়নাকে সাউথ চায়না সি নিয়ে কোন অন্যায় পথে না যাবার জন্যেই বলেছে। এবার কোয়াডে যে চারজন সরকার প্রধান মিলিত হলেন, তার মধ্যে আমেরিকা ও জাপানের সরকারের প্রধান ব্যক্তি খুব শীঘ্রই তাদের পদ থেকে চলে যাবেন। সেখানে নতুন মুখ দ্বায়িত্ব নেবেন। অস্ট্রেলিয়ার সরকার প্রধানও এক বছরের কম সময়ের মধ্যে চলে যাবেন। তাই এখানে পুরানো মুখ বলতে আগামী চার বছরে বেশি সময় থাকছেন,  ভারতের সকরার প্রধান নরেন্দ্র মোদি।

লক্ষ্যনীয় বিষয়, মি. মোদি এ মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যতম একটি সমস্যা এবং কোয়াড়ের মূল দেশ আমেরিকার সব থেকে বড় সমস্যা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে মধ্যস্থততা করছেন। যে কারণে ইউএন সামিট কালেও মোদির সঙ্গে জেলেনেস্কি আবারও বৈঠকে মিলিত হন। তাই স্বাভাবিকই ধরে নেয়া যায় ইউক্রেন ও রাশিয়ার এই বিরোধ মেটানো বা কমানোর কাজ শুরুর আগেই ভারতের নেতা ইউক্রেন পক্ষের মূল শক্তি আমেরিকা ও রাশিয়ার অন্যতম মিত্র শক্তি চায়নার দিক থেকে সবুজ সংকেত জোগাড় করছেন অথবা পেয়েছেন। যা কোভিড ও কোভিড পরবর্তী সময়ের থেকে নিঃসন্দেহে একটা পরিবর্তিত ঈংগিত।

তাছাড়া, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌঁড় থেকে বাইডেন সরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর রাজনীতি থেকে একটা পুরানো যুগের অবসান হয়েছে। কারণ বাইডেনই বর্তমান পৃথিবীতে একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন যিনি কোল্ড-ওয়ারের সময়ের রাজনীতিক। তাই তাঁর এই দৌঁড় থেকে পড়ে যাবার পর পরই কোল্ড-ওয়ার যুগের রাজনীতিকদের রাজনীতি শেষ হয়ে গেলো। এবং বলা যেতে পারে আমেরিকাও কোল্ড-ওয়ার যুগের রাজনীতি থেকে বের হবার পথে যাত্রা শুরু করলো।

 

পুতিন কোল্ড-ওয়ার যুগের একজন তরুণ বুরোক্র্যাট থেকে রাজনীতিতে এসেছেন। এবং তার কাজের ভেতর কোল্ড-ওয়ার যুগের সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই গন্ধ ও ধারা পাওয়া যায়। তবে এ মুহূর্তে কূটনীতির যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে তাতে পুতিন তার ক্লোড-ওয়ার যুগের ধারা একা বজায় রাখতে পারবেন না। কারণএকদিকে তিনি এখন আর সাবেক সোভিয়েত সরকারের মতো এককভাবে আমেরিকার প্রতিদ্বন্ধি নন। তাছাড়া সোভিয়েতের যে জোট ছিলো সেটা তাঁর নেই। অন্যদিকে আমেরিকার ন্যাটো ও কোয়াড জোট আছে। তবে ন্যাটো ও কোয়াড জোটের থেকেও আমেরিকা তার নভেম্বরের নির্বাচনের ভিতর দিয়ে আরো বড় পাওয়ারের অধিকারী হবে। সেটা নিঃসন্দেহে সফট পাওয়ার।

কারণ, আমেরিকার এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে যেই আসুক না কেন- ট্রাম্প বা কমলা উভয়েই আমেরিকা গ্রেটের দিকেই মনোযোগ দেবেন। ট্রাম্পের ঘোষিত নীতিতে ইতোমধ্যে তা বলা হয়েছে। অন্যদিকে কমলা হারিসের বক্তব্য প্রমান করছে, তিনি কোল্ড-ওয়ার যুগের ডেমোক্র্যাট নন, তিনি ওবামা যুগের ডেমোক্র্যাট। তিনিও ওবামার নীতিকে বিশ্বাস করেন,  “ আমেরিকার দ্বায়িত্ব তার নিজের দেশকে সব দিক থেকে শক্তিশালী করা। বিশ্ব পুলিশিং এর দ্বায়িত্ব আমেরিকার নয়” । তাই স্বাভাবিকই ২০২৫ সালের আমেরিকার নীতি অনেকটা পরিবর্তিত নীতি হবে। যা অনেক বেশি ইনকুলুসিভ এবং অনেক বেশি আইসোলেশান বিরোধী।

তাছাড়া আমেরিকার যে কোন রাজনীতিককে মনে রাখতে হচ্ছে  ২০৩৫ এর পরে সেখানে মূল আমেরিকানরা সংখ্যালঘুর দিকে চলে যাবে। তাই সে দেশের রাজনীতির পথকে আমেরিকা গ্রেট ও ইনকুলুসিভ না করলে তাদের রাজনীতি এবং রাষ্ট্র উভয়েই মুস্কিলে পড়বে। আর এ হাওয়া তাদের নির্বাচনী প্রচার থেকেই বইতে শুরু করেছে।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World. 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024