হারুন উর রশীদ স্বপন
অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে সারা দেশের পূজামণ্ডপগুলোতে এখন প্রতিমা বানানোর কাজ চলছে৷ কিন্তু এরইমধ্যে দেশের কয়েকটি এলাকায় প্রতিমা ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে৷
হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে বারবার আশ্বস্ত করা হচ্ছে৷ কিন্তু তারপরও ঘটনা ঘটছে৷
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ভোর রাত চারটার দিকে ময়মনসিংহের গৌরীপুরের মধ্যবাজারে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে৷ ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ বৃহস্পতিবার সকালে এক যুবককে আটক করেছে৷
গৌরীপুর মধ্যবাজার পূজা কমিটির সাবেক সভাপতি পীযূষ রায় সংবাদমাধ্যমকে জানান, ২০ দিন ধরে মন্দিরটিতে প্রতিমা বানানোর কাজ চলছিল৷ শুধু প্রতিমার রঙের কাজ করা বাকি ছিল৷ পূজা শুরুর এক দিন আগে মন্দির থেকে মণ্ডপে প্রতিমা নেওয়ার কথা ছিল৷ ‘‘কিন্তু বৃহস্পতিবার ভোর রাত চারটার দিকে এক তরুণ মন্দিরে ঢুকে প্রতিমা ভাঙচুর করেন৷ সেখান থেকে ভাঙা প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার সময় মন্দিরের পাশের বাড়ির ডলি রানি দেখতে পেয়ে চিৎকার করেন৷ এ সময় অখিল চন্দ্র বিশ্বশর্মা ও বিপুল ঘোষ এসে তরুণকে ধরে ফেলেন৷ পরে সকালে এসে পুলিশ নিয়ে যায়,” বলে জানান তিনি৷ পীযূষ রায় জানান, আগে তাদের মন্দিরে কখনো প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি৷
১৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে দুইটি মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে৷ ফরিদপুরের ভাঙ্গা বাজারের গুড়পট্টি এলাকায় অবস্থিত ‘ভাঙ্গা বাজার সার্বজনীন হরি মন্দির’ এবং ভাঙ্গা থানার সামনে অবস্থিত ‘ভাঙ্গা সার্বজনীন কালি মন্দির’-এ এই ঘটনা ঘটে৷ ৭৫ বছর ধরে ওই মন্দিরে দুর্গাপূজা হচ্ছে৷ মন্দির দুইটিতে প্রতিমা ভাঙার অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ প্রথমে তাকে ভারতীয় নাগরিক বলে প্রচার চালিয়েছিল৷ পরে অবশ্য দেখা যায় তিনি ঐ এলাকার বাসিন্দা এবং বাংলাদেশি নাগরিক৷
‘আশ্বস্ত হতে পারছি না’
গত ২০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে বরগুনা সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের গলাচিপা গ্রামের সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়৷ মন্দিরটির সভাপতি বিপুল সমাদ্দার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘রাতের কোনো এক সময় দুর্বৃত্তরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে৷ সকালে মন্দিরে গেলে বিষয়টি নজরে আসে৷ পরে সবাইকে জানানো হয়৷ এই ঘটনার পর থেকে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে৷ চার-পাঁচটি প্রতিমা ভাঙা হয়েছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘আমরা থানায় অজ্ঞাত পরিচয়দের আসামি করে মামলা করেছি৷ কিন্তু এখানো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ পুলিশ ও প্রশাসন আমাদের নিরপত্তার আশ্বাস দিয়েছে৷ কিন্তু আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না৷”
বিপুল সমাদ্দার জানান, ‘‘এখন যে প্রতিমাগুলো ভাঙা হচ্ছে সেগুলো নির্মাণের শেষ পর্যায়ে৷ এখন নতুন করে প্রতিমা নির্মাণ বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে৷”
উত্তরা মাঠে এবার পূজা হচ্ছে না
খেলার মাঠে দুর্গাপূজা করার বিরুদ্ধে কিছু লোক অবস্থান নেওয়ায় এবার ওই পূজা হবে উত্তরার ‘মুগ্ধ চত্বরে’৷
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দীপঙ্কর ঘোষ বলেন, ‘‘প্রতিবছরই উত্তরা মাঠে দুর্গাপূজা হতো৷ এবার কী এমন হলো যে সেখানে করা যাবে না৷ এ থেকে আমরা অদৃশ্য চাপ অনুভব করছি৷”
তিনি জানান, ‘‘এরইমধ্যে ফরিদপুর, বরগুনা, নিলফামারী, লক্ষীপুরে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে৷ এমনকি একদিন আগে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে৷”
দীপঙ্কর ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা সরকারের সব পর্যায়ে বৈঠক করেছি৷ তারা আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করছেন৷ কিন্তু আমরা এখনো আশ্বস্ত হতে পারছি না৷ আর এটা শুধু পুলিশি নিরাপত্তা দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব নয়৷ এর জন্য দরকার সমাজের সব মানুষের সহযোগিতা৷”
কলাবাগান মাঠে এবার পূজা হবে
বাংলাদেশ পূজা উযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা বলেন, ‘‘উত্তরায় যেটা হয়েছে, আমরা আলোচনার ভিত্তিতেই মাঠ থেকে পূজা আরেক জায়গায় সরিয়ে নিয়েছি৷ এটা নিয়ে আর কোনো সমস্যা নাই৷ আর কলাবাগান মাঠে পূজা বন্ধ করেছিলেন সাবেক মেয়র তাপস৷ এবার কলাবাগান মাঠে পূজা হবে৷”
তিনি জানান, ‘‘সারাদেশে কতগুলো মণ্ডপে প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে তার সঠিক হিসাব আমাদের কাছে এখনো নেই৷ তবে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি৷ অভিযোগগুলো যাচাই বাছাই করে আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই তথ্য প্রকাশ করব৷ কবে ৫ আগস্ট থেকে এপর্যন্ত আমরা মন্দিরে হামলাসহ নানা ধরনের হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ পেয়েছি দেড় হাজারের বেশি৷”
সন্তোষ শর্মা বলেন, ‘‘আমরা প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের পূজার নিরাপত্তা চেয়েছি৷ এখন পর্যন্ত সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে আমরা আশ্বস্ত৷”
তিনি জানান, ‘‘এবার সরকারি হিসাবে ৩২ হাজার ৬৬৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হবে৷ তবে আমরা বলছি ৩২ হাজার প্লাস৷ আমরা চেষ্টা করছি যেন পূজা উৎসব মুখর পরিবেশে হয়৷”
তিন স্তরের নিরাপত্তা
এবার পূজায় তিন স্তরের নিরাপত্তার কথা বলছে পুলিশ৷ পূজার আগে, পূজার সময় ও পূজার পরে৷ পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এরইমধ্যে পূজা ও পূজা মণ্ডপের প্রথম স্তরের নিরাপত্তার কাজ শুরু হয়ে গেছে৷ আমাদের অবস্থান হলো, এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে কেউ যেন পূজাকে কেন্দ্র করে অশান্তির চেষ্টা না করতে পারে৷ সেজন্য আমরা কঠোর অবস্থানে আছি৷ কেউ চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে৷”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের আমরা আইনের আওতায় আনছি৷ ওইসব মন্দিরে বিশেষ নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে৷ আর নতুন করে যাতে কোনো ঘটনা না ঘটে সেজন্য আমরা নজরদারি আরো বাড়িয়েছি৷ আর কারুর কাছে যদি এই ধরনের কোনো তথ্য থাকে আমাদের জানানোর আহ্বান জানাচ্ছি৷ আমরা তথ্য পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেব৷ এই ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছি৷”
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দীপঙ্কর ঘোষ বলেন, ‘‘আসলে আমরা প্রতিটি হামলার বিচার চাই৷ এপর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর বিচার হলে এই পরিস্থিতি হতো না৷”
ডিডাব্লিউ ডটকম
Leave a Reply