ড. সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়
মায়াদের শিল্পীমন এবং দক্ষতার পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে কোপানে আবিষ্কৃত সিঁড়ির (Stairway) স্থাপত্যের মধ্যে। বারান্দাটি অনেকটাই চিত্রাঙ্কণ দ্বারা সাজানো। এই অঞ্চল বা কমপ্লেক্সটিতে স্ট্যাচু বা বড় মুতি আছে। আছে নানা ধরনের বস্তু, দৈহিক গড়ন। এই সুদৃশ্য অঞ্চল-এর মধ্যে খালি জমির (বা landscape) প্রসারতা বা গভীরতার সৌন্দর্য স্পষ্ট অনুভব করা যায়।
একটি বেদীর মত নির্মাণ এই অঞ্চলের গাম্ভীর্য বাড়ায়। এছাড়া কিছু ছবি আছে যার মধ্যে তাদের দেবতাদের প্রতি বলিদান বা ত্যাগের অর্থ প্রতিফলিত হয়েছে। এর থেকেও লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল নানা ধরনের কাল্পনিক কাহিনীকে ছাড়িয়ে রাজাদের বংশানুক্রমিক ধারার ইতিহাস এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে।
আচার, বিচার এবং ধর্মীয় বিশ্বাস: মায়া সংস্কৃতি, স্থাপত্য এবং শিল্প-বাণিজ্য সম্পর্কিত কিছু অঞ্চলের উল্লেখ করা হয়েছে। এইসব বৈশিষ্ট্য এবং দ্রব্য উৎপন্নর সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের লোকাচার, লোকনীতি, আচার-রীতির ভূমিকা থাকে। আসলে মায়া দলগোষ্ঠী বা জনজাতি অনেক ক্ষেত্রেই জীবনযাত্রার সাধারণ অনেক বিষয়ের উপর ধর্মীয় বিশ্বাসের স্পর্শ যুক্ত করে দেয়।
এই ধর্মীয় লোকাচার যুক্ত করে মায়ারা তাদের জীবনযাত্রাকে নিরাপদ এবং মঙ্গলময় করে তুলতে চায়। তারা বিশ্বাসও করে যে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পেছনেও দেবতাদের আশীর্বাদ, ভাল-মন্দের ধারণা বা ইচ্ছা যুক্ত থাকে. কাজেই সংশ্লিষ্ট দেবদেবীর সন্তুষ্টি গড়ে তুলতে পারলে ব্যবহৃত দ্রব্য এবং জীবনযাত্রা সবই সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ থাকবে। উদাহরণ হিসেবে কিছু দ্রব্য এবং ধর্মীয় লোকাচার-এর উল্লেখ করা যাক।
প্রথমেই আমরা লাকানডন (Lacandon) মায়াদের কথা বলতে পারি। বিশ্বাস কার হয় যে লাকানডন (Lacandon) মায়াদের মূল সূত্র এসেছিল ভারতবর্ষ থেকে। লাকানডান লোকাচার সাধারণভাবে খুব সহজ ও সরল। লাকানডনদের ব্যবহার করা কিছু দ্রব্য বা বস্তু অনেক প্রাচীন। এবং এদের মধ্যে কিছু বস্তু মায়াদের প্রাচীন পুঁথি এবং তৈলচিত্রের মধ্যে দেখা গেছে। এই চিত্রগুলির সময়কাল সাধারণভাবে ক্লাসিককাল ২৫০-৯৫০ খ্রিস্টাব্দের।
লোকাচার রীতির আরেকটি উদাহরণ হল ইয়াতক কুন (Yatoch K’un) বা ঈশ্বরের বাড়ি। এই বাড়ি গ্রামের এক প্রান্তে তৈরি করা হয় এবং বিশ্বাস করা হয় এই ঘরে ধর্মীয় আচার-আচরণের সামগ্রী রাখা হয়। ঈশ্বরের এই বাড়ি বাঁশের মাচার মত খোলামেলাভাবে তৈরি করা হয়। বাড়ির পূবদিকের অংশে সাবেকি কায়দায় মদ তৈরি করা হয়।
মায়ারা এখনো বিশ্বাস করে যে এই অংশেই এবং এই মুহূর্তেই ঈশ্বর এবং সাধারণ মানুষ একসঙ্গে একত্রিত হন। ঈশ্বর এই (সময়ের) মাহেন্দ্রক্ষণে মানুষের প্রার্থনা মন দিয়ে শোনেন। ঈশ্বর এখানে ভক্তের দেওয়া নানা সামগ্রী গ্রহণ করেন। প্রতিদিনের বাস্তব এই ঘরে ঈশ্বর বা দেবতার ইচ্ছাস্পর্শে পবিত্র হয়ে ওঠে।
ধূপের গন্ধ এক মুহূর্তে ডিমের ওমলেট হয়ে যায়। পরে হয় মানুষের রক্তমাংসের শরীর। রাবারের পুতুল নাকি হয়ে যায় জীবনে ভরপুর এক অস্তিত্ব। এবং এই রূপান্তর প্রক্রিয়া শেষ হলে তাকে ঈশ্বরের কাছে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
(চলবে)
Leave a Reply