তিন বছর পরে ছেলে বাড়ি আসছে। খুশীর খবর শুধু এটা নয়। সঙ্গে আসছে নাতি একমাত্র বংশধর।
আনন্দ উপচে পড়ছে মালেক চৌধুরীর। বুড়ো মানুষ। সত্তরের ওপর বয়স হয়েছে। এতটা বয়স পাবার মতো স্বাস্থ্য তাঁর ছিল না। তবু কেন যে এতদিন বেঁচে আছেন, অনেকের মনে বিশ্বয় জাগে। তাঁর কাছেও কম আশ্চর্যের ব্যাপার নয় এটা। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, একটা বংশধর দেখবার জন্যেই খোদা তাঁকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি শুধু বলেনই না এ কথা, মনে প্রাণে বিশ্বাসও করেন।
তিন বছর আগে তিনি শয্যা নিয়েছেন। আজ মরেন কাল মরেন করে তিন বছর কাটিয়ে দিয়েছেন বিছানায়। উঠে বসতে পর্যন্ত পারেন না। আহারাদি সব কিছু শুয়ে শুয়েই হয়।
আজ চিঠির খবর শুনে তিনি চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। চিৎশয়ন থেকে কোন রকমে উপুড় হয়ে বলেন, রহিমা, চিঠিটা আমার হাতে দে তো মা। তুই আমার চশমা নিয়ে আয়।
রহিমা চৌধুরী সাহেবের মেয়ে। নিঃসন্তান বিধবা সে। বয়স তারও চল্লিশের ওপর। বুড়ো বাবার সেবা শুশ্রূষা তাকেই করতে হয়। মা বহুকাল আগে গত হয়েছেন।
রহিমা চিঠিটা দিয়ে উঠে যায় চশমা খুঁজবার জন্যে। শয্যা নেয়ার পর তাঁর আর চশমার দরকার হয়নি এতকাল। এখন কোথায় রয়েছে সেটা কে জানে? চৌধুরী সাহেব চিঠিটা হাতে নিয়ে নাড়া-চাড়া করেন। দৃষ্টিহীন চোখ মেলে চেয়ে থাকেন চিঠিটার দিকে। কিন্তু এক অক্ষরও নজরে আসে না। চিঠিটা তিনি চোখের খুব কাছে নিয়ে যান। কিছু দেখতে না-পেয়ে শেষে গালের সাথে চেপে ধরেন। চুমু খান বারবার। কি আনন্দের খবরই না নিয়ে এসেছে এ কাগজটুকু। ভার আনন্দের খবরই বটে। চৌধুরী সাহেবের একমাত্র পুত্র খালেক চৌধুরী। বয়স পয়তাল্লিশ। সাত সন্তানের জনক! কিন্তু এ সাতটির সব শেষেরটিই শুধু ছেলে। মাত্র আড়াই বছর বয়স হয়েছে তার।
পুত্রবধুর সন্তান-সম্ভাবনার খবর পেলে প্রথমদিকে প্রত্যেকবারই আকুল আগ্রহে তিনি দিন গুণতেন-এবার আসবে তাঁর বংশধর। বনেদী চৌধুরী বংশের নিবু নিবু চেরাগ জ্বলে উঠবে আবার। কিন্তু প্রত্যেকবারই তিনি হতাশ হয়েছেন। হতাশ হয়ে ছেলের হাতে তাগা-মাদুলী বেঁধেছেন। বউকে পানি পড়া খাইয়েছেন। বংশধর কামনায় আরো কত কি যে করেছেন তার ইয়াত্তা নেই। চতুর্থবার আশা ভঙ্গের পর তিনি আবার ছেলের বিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু শিক্ষিত ছেলে, বাবার প্রস্তাবে রাজী হতে পারেননি। এর পর থেকেই চৌধুরী সাহেবের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। বংশ রক্ষার আশা তিনি ছেড়েই দেন এক রকম।
তিন বছর আগে ছেলে করাচী বদলী হয়ে যাওয়ার পরে পরেই পিতা শয্যা নিয়েছিলেন। মাস ছয়েক পরে সেখান থেকে একদিন টেলিগ্রাম আসে-নাতি হয়েছে। ওহ! সে কী আনন্দের খবর। সেই খবরটাই তাঁর আয়ু-রেখা বাড়িয়ে দিয়েছে হয়োকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন। নাতির মুখ না দেখে তিনি আর মরতে পারবেন না। দেহের জোর নিঃশেষ-প্রায় হয়ে গেলেও মনের জোরে তিনি আজরাইলকে ঠেকিয়ে রেখেছেন এতকাল।
চৌধুরী সাহেব চিঠির পর চিঠি পাঠিয়েছেন ছেলের কাছে। বারবার একই কথা,- আমার নাতিকে নিয়ে বাড়ি এসো। আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যাও। আমি আর বেশি দিন বাঁচব না। ছেলে উত্তর দিয়েছে, দু’বছরের আগে যাতায়াত-খরচা দেবে না সরকার। নিজের খরচে অবশ্য যাওয়া যায়। কিন্তু এত টাকা কোথায় পাব? প্রায় তিন হাজার টাকা লাগবে যেতে আসতে।
তিন হাজার টাকা।
বৃদ্ধ ভেঙে পড়েন। ভাঙা নৌকা সেচতে সেচতে তিনি কালের দাঁড় টেনে চলেন। দুটি বছর-সমুদ্র পার হয়ে চিঠি লিখেন ছেলেকে। উত্তর আসে, নতুন নিয়ম হয়েছে।
আরো এক বছর পরে যাতায়াত খরচ পাওয়া যাবে।
আরো এক বছর! তিনশো’ পঁয়সট্টি দিন।
দিনের পৃথিবী চৌধুরী সাহেবের কাছে এতদিন জেছনা রাতের পৃথিবীর মতো ছিল। হঠাৎ নেমে আসে অমাবস্যার অন্ধকার। সে অন্ধকার যে তাঁকে পিষে ফেলবে।
চৌধুরী সাহেব শীর্ণ হাত দিয়ে তক্তপোশের কিনারা চেপে ধরেন। বাঁচতে তাঁকে হবেই। নাতির মুখ না দেখে কবরে গিয়েও তিনি শান্তি পাবেন না। নেহায়েত মনের জোরেই চৌধুরী সাহেব বেঁচে রইলেন আরো এক বছর। তারপর ছেলের চিঠি আসে,- আমরা ভাদ্র মাসের বারো তারিখে বাড়ি পৌঁছব।
আজ ভাদ্র মাসের দুই তারিখ। দশদিন মাত্র বাকী। এ-দশদিন বাঁচব তো? বৃদ্ধের মনে সংশয় উঁকি-ঝুঁকি মারে। মনে মনে বলেন, নিশ্চয়ই বাঁচব। এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছেন আল্লাহ্। আর নাতির মুখ না দেখিয়ে নিয়ে যাবেন এখন?
রহিমা চশমা নিয়ে আসে। ডাঁট-ভাঙা চশমা সূতো বেঁধে লাগিয়ে দেয় পিতার চোখে। চৌধুরী সাহেব চিঠিটা মেলে ধরেন। কিন্তু কিছুই দেখা যায় না। তিনি এবার রহিমার দিকে তাকান। কিন্তু তাকেও আবছা দেখায় আগের মতই।
চৌধুরী সাহেব মেয়েকে বলেন, কাচ মুছে দে ত মা, ভালো করে।
-মুছে দিয়েছি, বাবা। তিন বছর আগের চশমা কি আর এখন ঠিক হবে?
-হবে না! কি হবে রে তবে? নাতির মুখ কি আর দেখতে পাব না? একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তাঁর বুক থেকে।
রহিমা বুঝতে পারে সব। বলে, তুমি কিছু ভেবো না, বাবা। আমি আজই সদরে লোক পাঠাচ্ছি। চোখের ডাক্তার নিয়ে আসবে। নতুন চশমা নিলে তুমি ঠিক দেখতে পাবে।
-দেখতে পাব? দেখতে পাব? তাই যেন পাই। হ্যাঁ, তুই আজই সদরে লোক পাঠিয়ে দে।
সদর বেশি দূরে নয়। ডাক্তার আসেন। পরীক্ষা করে বলেন, চোখের জ্যোতি একেবারেই নেই। চশমা নিয়ে আর কোন ফল হবে না।
চৌধুরী সাহেবের তক্তপোশটা ঘুরতে ঘুরতে যেন নিচে নেমে যাচ্ছে। তিনি চোখ বোজেন। হঠাৎ যেন ধপ করে সেটা গিয়ে পড়ে কোন পাতালে। একটা ঝাঁকুনি অনুভব করেন চৌধুরী সাহেব। তাঁর চৈতন্য যখন ফিরে আসে তখন নিজেকে সান্ত্বনা দেন- নাতিকে চোখ দিয়ে না-ই বা দেখলাম। হাত বুলিয়ে তো অনুভব করতে পারব তার অস্তিত্ব। সে বেঁচে থাক। আমর চুল-দাড়ির সমান হায়াত যেন সে পায়।
চৌধুরী সাহেব সমস্ত নৈরাশ্য ঝেড়ে-মুছে যেন সতেজ হয়ে ওঠেন। মেয়েকে ডাকেন ভাঙা গলায়, রহিমা, লোক লাগিয়ে দে। সুন্দর করে ‘গেট’ সাজাক। আমার নাতি আসবে, চৌধুরী বংশের বাতি। আর ঘরগুলোও সাজিয়ে নে। দু’দিন তো মাত্র বাকী।
ঘরদোর সাজিয়ে নেয় রহিমা। দেবদারু পাতা দিয়ে তোরণ তৈরি হয়। তারপর আসে ১২ই ভাদ্র-বহু প্রতীক্ষিত দিনটি।
ভোরবেলা থেকে চৌধুরী সাহেব কান পেতে রয়েছেন। যদিও বিশেষ কিছু শোনেন না কানে, তবুও অন্য সব ইন্দ্রিয়ের চেয়ে এটাই বেশি কর্মক্ষম। বারবার তিনি রহিমাকে ডেকে বলেন-দেখতে পেলি মা, নৌকা?
রহিমা বিলের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে পিতাকে এসে খবর দেয়-এখনো দেখা যায় না, বাবা।
অবশেষে দুপুরবেলা নৌকা এসে বাড়ির ঘাটে ভিড়ে। খবর পেয়ে চৌধুরী সাহেব বিছানার তলা হাতড়ে কি একটা মুঠোয় ভরে নেন। তারপর অনেক কষ্টে চিৎ অবস্থা থেকে উপুর হন।
দরজার গোড়ায় পায়ের শব্দ শুনে বলে ওঠেন, কে? খালেক?
-জী, বাবা। কই আমার দাদু? আমার বংশের চেরাগ কই?
-এই ত, বাবা। নাতিকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসে রহিমা। চৌধুরী সাহেব হাঁটু ও কনুই-এ ভর দিয়ে উঠেন। তাঁর লম্বা চাপদাড়ি বিছানা স্পর্শ করে।
-দে দে, আমার কাছে দে। চোখ তো আর নেই। হাত বুলিয়ে দেখে নিই আমার দাদুকে।
রহিমা কোল থেকে নামাতে যাবে অমনি বেলু চীৎকার করে ওঠে। সে ভয় পেয়েছে।
তাড়াতাড়ি তাকে অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার কান্না তবু থামে না। তার চোখে-মুখে কি রকম ভীত-শঙ্কিত দৃষ্টি।
খালেক মিয়া ছেলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কিরে, কি? কাঁদছিস কেন? বেলু কথা বলে না। একবার শুধু অস্পষ্টস্বরে বলে, থিংগ। খালেক মিয়া বুঝতে পারেন-তাঁর দাড়িওয়ালা বুড়ো বাবাকে চার হাত-পায়ে ভর দেয়া অবস্থায় দেখে ভয় পেয়েছে ছেলে। করাচী থেকে রওনা হওয়ার কয়েকদিন আগে
চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়েছিলেন ওদের। সিংহের চেহারা বেলুর মনে আছে এখনো। ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে খালেক মিয়া পিতার ঘরে গিয়ে দেখেন-বালিশে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন পিতা। তাঁর বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে। গায়ে হাত দিয়ে দেখেন- নিথর নিস্পন্দ দেহ।
মৃত চৌধুরী সাহেবকে গোসল করাবার সময় তাঁর হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় একখানা গিনি।
Leave a Reply